আমি খুব ভালো করেই জানি আমার এই লেখাটা প্রধানমন্ত্রী অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নজরে আসবে না। ভুলেও যদি কখনো চলে আসে তাহলে দয়া করে এড়িয়ে যাবেন না। গতকালের প্রায় প্রত্যেকটা সংবাদপত্রে ইউএই এর ভিসা বন্ধের সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। তারই কিছু কথা নিয়ে আমার এই লিখা।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউএই বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করে। সেই রক্ষনশীলতার নীতি গ্রহণ করার পর গত সপ্তাহে ইউএই বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য সবধরনের ভিসা বন্ধ করে দেয়। কর্মসংস্থান বা এমপ্লয়মেন্ট ভিসা, ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণ ভিসা এবং সব ধরনের বাণিজ্যিক ভিসা প্রদান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০১২ থেকে আজ পর্যন্ত দেড় বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও ইউএই সাথে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা হয়নি। কিন্তু কেন?
মাফ করবেন আমাকে, আমি আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর চাই না। জাহাজের খবর আপনারাই ভালো জানেন আমাদের চেয়ে। আমি না হয় আদার ব্যাপারী এতকিছু জানি না কিন্তু আপনারা যখন দেশ চালান তখন আপনাদেরতো আর মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় না যে রেমিট্যান্স আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস এই ইউএই। নিজে বাঁচিনা আবার বাপের নাম। রেমিটেন্সের আয় কমে যাবে সেটা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যাথা নাই কারণ আগে নিজের পেটে ও নিজের ফ্যামিলির পেটে আহার দিয়ে তারপর
আসবে রেমিটেন্স নিয়ে চিন্তা ভাবনা। সৌদিআরবের পর এই দেশটি হচ্ছে রেমিটেন্স আয়ের দ্বিতীয় উত্স। কিন্তু গত দেড় বছর হয়েগেল আমাদের বাংলাদেশীদের জন্য কোনো নুতুন ভিসা প্রদান করা হচ্ছে না। আপনাদের কি এটা দায়িত্বের মাঝে পরে না একটি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসা? কেন শুধু একটু আলোচনার অভাবে আজ বিপন্ন বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ১৫ লক্ষ্য মানুষ ? আপনাদের একটু আলোচনার মাঝেই সম্ভব হত এর একটি সুষ্ঠ সমাধান। কিন্তু আজ আমাদের ভাগ্যকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে আল্লাহর উপর।
বর্তমানে এই দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মোট ২৩ লক্ষ্য বাঙালির বসবাস। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়কেই বলছি যে আপনারা জানেন কিনা জানিনা তবে যারা এই প্রবাসে আছি তাদের একেক জনের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তাদের পরিবারটি। আমরা যারা প্রবাসে আছি, কারো যদি তাদের পরিবারে দুরাবস্থা না থাকত তাহলে আমরা কেউ দেশ ছেড়ে এই প্রবাসে পরে থাকতাম না। রোদ ,বৃষ্টি ,তুফান সব মাথায় নিয়েই কাজ করে যাই শুধু নিজের পরিবারের মুখে ফোটানোর জন্য। বিশ্বাস করুন কারো যদি পিছুটান না থাকত তাহলে আমাদের কে কেউ এখানে আটকে পারত না। সকল নির্যাতন আমরা মুখবুঝে সহ্য করে যাই। আমাদের এখানে দিন রাতের কোনো ব্যাবধান নেই সবই সমান। আপনারা কি একবারও ভেবেছিলেন যে এই ২৩ লক্ষ্য প্রবাসী শ্রমিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তাদের ৪ থেকে ৫ জন সদস্য দ্বারা গঠিত প্রতেকটি পরিবার? হিসাব করে দেখুন দয়া করে এই ২৩ লক্ষ প্রবাসীর জন্য ক্ষতির মুখে পরেছে তাদের সব পরিবার। সবাইকে মিলিয়ে যার মোট সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ১৫ লক্ষ্য মানুষ। আমরা শুধু শ্রমিকরাই এখানে থাকি না এখানে অনেকে প্রতিষ্টিত করেছেন অনেক ব্যাবসা বাণিজ্য। এখনো সময় আছে চোখ খোলে তাকান আমাদের দিকে।
কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ থাকা এ দেশের দরজা এখন বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য একেবারেই বন্ধ। এখানে অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের ভবিষ্যত কি হবে কেউই তা বলতে পারে না। ভিসা নবায়ন ও আনুষঙ্গিক কাজে সৃষ্টি হয়েছে এই বৈরী আবহওয়া। ধরপাকড় চলছে সবখানে। এসব সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে হা সমাধানের কোনো পদক্ষেপ না নিলেও নিয়েছেন আমাদেরকে আরো নির্যাতিত করে রাখার পদক্ষেপ। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আজকে আমাদের এই এক কোটি মানুষের জীবন নিয়ে খেলছেন আপনারা। আপনাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই আজ আমাদের প্রবাসীদের এই অবস্থা।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ভিসা প্রদানে রক্ষনশীল নীতি গ্রহণ করলেও আমাদের প্রবাসীদের আশা ছিল সরকার একটি আলোচনার মাধ্যমে তার একটা সমাধান করবে কিন্তু আমাদের সরকার তা না করে সমস্যাটা আরও জটিল করে তুলল। সঙ্কটের শুরু মূলত ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর ভেন্যু নির্বাচনের ভোট দেয়াকে ঘিরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রদর্শনীর আয়োজক হওয়ার প্রতিযোগিতায় ছিল বেশ কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, তুরস্কের ইজমির, ব্রাজিলের সাও পাওলো, রাশিয়ার একাতেরিনবার্গ ও থাইল্যান্ডের একটি শহর। এর মধ্যে প্রার্থিতার শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় থাইল্যান্ড প্রাথমিক পর্যায়েই বাদ পড়ে। প্রতিযোগিতায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ভোটের ব্যাপারে সবচেয়ে আশাবাদী ছিল দুবাই। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ভোট পাবে রাশিয়ার একাতেরিনবার্গ । ২৬শে নভেম্বর ২০১৩, প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ব্যুরোর ১৫৪তম সাধারণ অধিবেশন। সেখানেই ভোটাভুটির মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর স্বাগতিক দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ ভোট দেয় রাশিয়ার একাতেরিনবার্গের পক্ষে। তবে শেষ পর্যন্ত গোপন ভোটাভুটিতে জিতে ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর স্বাগতিক শহর নির্বাচিত হয় দুবাই। যার নুন খেতে হয় তার গুন গাইতে হয়। বাংলাদেশ সরকার যখন দুবাইকে এড়িয়ে রাশিয়াকে ভোট দিবে আর শেষ পর্যন্ত ফলাফল যখন দুবাইয়ের পক্ষে হয় তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাংলাদেশীদের ভিসা বন্ধ করে দেওয়ার পিছনে যথাযুক্ত কারণ থাকবেই। সরকারের হঠকারিতার কারণে ইউএইতে থাকা লাখ লাখ বাংলাদেশী এখন ভাগ্য বিপর্যয়ের মুখে। অথচ ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর স্বাগতিক দেশ হিসেবে দুবাইকে সমর্থন দেয়ায় নেপাল ৩ লাখ শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ পাচ্ছে। দুবাইকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশও এর চেয়ে বেশি সুযোগ নিতে পারতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সরকার সে পথে অগ্রসর হয়নি। সমাধানতো করলেন না বরং ঠেলে দিলেন ২৩ লক্ষ পরিবারকে অনিশ্চয়তার দিকে। আপনাকে ধন্যবাদ না দিয়ে আর পারলাম না।
তবে একটা কথা খেয়াল রাখবেন আপনাদের আলোচনাই পারত একটি সমাধানের পথ বের করতে। আপনার আলোচনার অভাবে যখন এতগুলো মানুষের জীবন বিপন্ন হতে যাচ্ছে ভাববেন না এর দায় আপনাকেই নিতে হবে। তাই এখনো আপনার কাছে সবিনয় নিবেদন জানাচ্ছি যে চেয়ারে যখন বসছেন দয়া করে সেই চেয়ারটি ছেড়ে একবার এখানে এসে দেখুন আমরা কত কষ্ট করে বেছে আছি এই প্রবাসে। একবার আসুন আপনারা। আপনাদেরকে তো প্রতিদিনই টেলিভিসনে দেখি কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, একদিন না হয় একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন না তারপরও আমাদের মনে একটা আশারবাণী ফোটে উঠবে। পদক্ষেপ নিন এটাই আমি সহ ২৩ লক্ষ নাগরিকের আকুল আবেদন।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন