ঘুম থেকে সকাল বেলায় উঠেই টুথব্রাশের উষ্ঠাগত প্রাণ দেখে দৌড়ে গেলাম নিচের লোকমান মিয়ার বউ-এর মুদির দোকানে (লোকমান মিয়া অসুস্থ তাই তার বউ দোকান পরিচালনা করে) । মুদির দোকানে টুথব্রাশ কিনতে গিয়ে শুনি দোকানে গান বাজছে, গানের কলিটা ছিলো এমন -
“আমি থাকি বাংলাদেশে তুমি থাক দুবাই,
মোবাইল দিয়া চুমা দিলে কোনো শান্তি নাই”
জিজ্ঞেস করলাম কি খালাম্মা সকাল বেলা এই গান ব্যপার কি ?
-আরে আর কইও না, ওই শালার (উনার স্বামী) যেই ব্যরামে ধরছে মনে হয় এইবার মরবো। আমার আর ভাল্লাগে না এই জ্বালা, তাই মনের দুক্ষে গান হুনি।
উনার উদাসী কথাটা শুনে আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসলাম, সবার মনেই তো যন্ত্রণা থাকে, গান শুনে যদি উনার যন্ত্রণা দূর হয় তাহলে আমার ক্ষতি নাই। তাই টুথব্রাশ নিয়ে বাসায় এসে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়ে গেলাম নাস্তা না করেই কারণ গ্যাসের সিলিন্ডার গতরাতে শেষ হয়ে যাওয়াতে গ্যাস চুল্লীর মুখটাও ছিল খুব উদাসীন। গ্যাস চুল্লীর উদাসীন মুখ দেখে আমার মা যখন বাবাকে বলল নুতুন সিলিন্ডার কিনে আনতে তখন বাবা হাস্যজ্জ্বল মুখটাতে উদাসীন ভাব নিতে কালক্ষেপন করলো না। যাইহোক আমি পালাই কারণ কখন যে আমি আবার এই জালে জড়িয়ে পরি তার কোনো ঠিক নাই।
অফিস খুব সন্নিকটে হওয়ায় পদব্রজেই পৌঁছে গেলাম। পৌছানোর সাথে সাথেই অফিস বয়কে ডাকলাম। সে আসলে দেখালাম তার মুখটাও একটু উদাসীন হয়ে আছে যাইহোক ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে তাই আর কথা না বাড়িয়ে তাকে বললাম নাস্তা নিয়ে আয়, মেনুটাও বলে দিলাম কি আনতে হবে। সে যথা সময়ে নাস্তা নিয়ে আমার টেবিলে হাজির আজ। আজকের আগে তা কখনো হয়নি। এর আগে যতবারই তাকে দিয়ে নাস্তা আনিয়েছি প্রতিবারই সে গরম গরম নাস্তাকে ঠান্ডা করে আমার সামনে হাজির করেছে। আজকে তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম যখন দেখলাম নান রুটি থেকে গরম গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
-তুইতো অজ্যিয়া সেরহম খাম গড়ি ফেলাইয়্যুছ। এতো সড়ে সড়ে লইয়াচ্চুছ? ধৈন্যবাদ যা।
(তুই তো আজকে খুব ভাল কাজ করেছিস।এত তাড়াতাড়ি নিয়ে আসলি ? ধন্যবাদ )
-বদ্দা ন আনিলে কেন অইবো ? অনে আর বস ন না ?
(ভাই না আনলে কিভাবে হবে আপনি আমার বস না ?)
-আইচ্চা যা এহন।
(আচ্ছা যা এখন )
- বদ্দা ওগ্গু খতা হইয়্যুম না ?
(ভাইয়া একটা কথা বলবো?)
-আইচ্চ়ে
(আচ্ছা )
-বদ্দা রাতিয়্যা ওগ্গু কম আছিল টিয়্যা দিত ফারিবানা কিছু ?
(ভাইয়া কিছু টাকার দরকার ছিল রাতে একটা কাজ আছে ,দিতে পারবেন ?)
-কত ?
-১০০০টিয়্যা।
(১০০০টাকা)
তখন তাকে টাকাটা দিলাম। টাকাটা হাতে নিয়ে সে আমাকে বললো ::
-বদ্দা বহুত বড় উপকার ওইয়্যে গোডারাইত ইবার টেনসনে ঘুম যাইন্ন্য পারি।
(ভাইয়া বড় উপকার হলো, সারারাত এটার টেনশনে ঘুম যেতে পারিনি)
এই কথাটা বলেই সে চলে গেল সাথে সাথে গরম নাস্তার কথাভুলে ভাবতে লাগলাম কিরে মাত্র এক হাজার টাকার জন্য সে রাতে ঘুমাতে পারল না ? আর এই এই অল্প টাকাটার জন্যই তার মুখটা একটু আগে উদাসীন ছিলো। যাইহোক আগে খেয়ে নেই, এখনো অফিসের সব সহকর্মীরা আসেনি।
সকাল তখন ১০টা ৪৫ মিনিট।
হঠাৎ কাজের ফাকে মনে পড়ল আমার গার্ল ফ্রেন্ড মানে আমি যাকে ভালবাসি আর কি তার আজকে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা। পরীক্ষা শুরু হবে ১১তা থেকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সাথে সাথেই তাকে ফোন দিলাম। দুই’বার ফোন দেওয়ার পরও যখন ধরল না তখন বুঝে নিলাম ডাল ম্যা কুচ কলা হ্যায়। ভয়ে ভয়ে ছিলাম অনেক ক্ষণ না জানি পরীক্ষা শেষে কি প্রলাপ শুনতে হয়। ভয় তা বেশিক্ষণ থাকলো না যখন বস-এর কর্কশ গলা শুনতে পেলাম। বস ডাকছে
-জী বস?
-আপনাকে একটা কথা বলতে চাই যদি কিছু মনে না করো ?
-জী বস, নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।
-কি যে বলতাম !! আমার ছোট ছেলেটার ইদানিং খুব অবনতি হচ্ছে ওকে এখন আর বাসায় রাখার কোনো উপায় নেই। ভাবছি ওকে কোনো মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে দিয়ে দিবো। তোমার কি কোনো অভিজ্ঞতা আছে কোথায় দিলে ভালো হবে? আমার এই একটা ছেলে মাত্র সে দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাদকের ফাঁদে পড়ে।
বলতে বলতে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার চোখের কোণে।
আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে “অশ্রু” মাদক নিরাময় কেন্দ্রটি ভালো হবে আর তাছাড়া সেখানে আমার এক পরিচিত মানুষের শরণাপন্ন হওয়া যাবে। শুনে তিনি খুসি হলেন এবং একটু পূর্বের সেই কালো ছায়াটা দূর হয়ে একটু মিষ্টি রোদের হাসি দেখা যাচ্ছে।
সময় চলে যাচ্ছে ঘড়ির কাটা দেখি একটু ভালো করেই দৌড়াচ্ছে আজকে। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। খেতে যাব এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। মোবাইলের পর্দায় প্রিয় বন্ধুর নামটি দেখাতে একটু ভালো লাগলো সকাল থেকে শুধু মানুষের উদাসীনতা দেখেছি ও আবার সবসময়ই একটু চঞ্চল টাইপের। যাইহোক ফোনটা ধরে শুনলাম বন্ধুর উত্তেজনাপূর্ণ কন্ঠ।
-দোস্ত কই তুই?
-আরে দোস্ত আর বলিস না সুমিকে(অর গার্ল ফ্রেন্ড) এই মাত্র দেখলাম অন্য একটি ছেলের সাথে কাজী নজরুল স্কোয়ারে ঢুকছে। তুই একটু আয় দোস্ত আমি যে পাথর হয়ে যাচ্ছি।
-আচ্ছা, আচ্ছা তুই থাক আমি আসছি।
-আরে বসে থাক তোরা। বড় হয়েছিতো কি হয়েছে ? আমিতো সবসময় তদের সাথে বন্ধুর মত চলাফেরা করি, তোদেরকে অনেক ভালবাসি।
আরেক বন্ধু মাঝখান থেকে বললো :
-ভাই আজকে হঠাৎ এইখানেই চলে এলেন আপনি না এসে আমরা বললেই তো আমরা চলে যেতাম।
-সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম তুদেরকে পাব এখানে জেনে ভাবলাম একটা খবর দিয়ে যাই। আগামীকাল সকালে একটু তোরা সবাই থাকিসতো। কালকে একটা মিটিং আছে সেখানে আমরা একটা মিছিল নিয়ে যোগ দিব। আমি চাই অন্যদের চেয়ে আমার মিছিলের লোকসংখ্যা একটু বেশি হোক।
এইগুলো শুনার পর তাকে আশ্বস্ত করলাম আমরা সবাই যাব যদিও জানি কেউই যাব না আমরা। তিনিও চলে গেলেন সানন্দে তবে আমাদের আড্ডাটা যে বিষাদময় করে দিয়ে গেছেন সেটা এখন সবার মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। ঠিক এমন সময়ই মোবাইলে আসল ম্যাসেজ:
হলো তো এবার?? কি আর করা সাথে সাথে ফোন দিয়ে তার দোষ স্বীকার করে তার গলাতেও সান্তনার মালা পরিয়ে দিলাম।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হল আর এই সময়টাতে কত যে উদাসীনতা দেখেছি সেটা লিখতে গেলে পাঠকরা উদাসীন হতেও দেরী করবেন না। রাতে বসে বসে ভাবছিলাম আমরা প্রতিদিন কত কিছুতেই না উদাসীনতা দেখি। আজকাল রক্তের সাথে বিষাক্তভাবে এই উদাসীনতা মিশে গেছে আমাদের।আমরা বুঝতে চাই না যে এই উদাসীনতার প্রতিফলনে আমরা আমাদের নিজেদের পরিচয় ভুলে যাচ্ছি। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলে লক্ষ্য করা যায় কত মানুষের বিচরণ আমাদের চারপাশে আর সবাই যেন নিজেকে উদাসীনতার সাগরে ডুবিয়ে রাখতেই ভালবাসে। কিন্তু সেটা কেন ? তাতে কি লাভ???
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন