তুমি আসবে না
নিঃশব্দে নিঃসঙ্গ এই চেনা
বাগানের দরজা খুলে ফাল্গুনের বিহ্বল দুপুরে
মাড়িয়ে ঘাসের পিঁপড়ে, শুকনো পাতা
সিঁড়ির নির্জন বাঁক ঘুরে
এসে শিশিরের মতো স্বেদকণা মুছে মিহি রুমালে,
হাওয়ায় প্রীত তুমি মৃদু টোকা দেবে না দরজায়;
গানের গুঞ্জনে আর উঠবে না ভরে
দক্ষিণের শূন্য ঘর প্রহরে প্রহরে।
যে-চোখে ফুলের ঝাড়, ফলের গুচ্ছের ভার দেখি
সেই চোখ চোখই থাকে অনাদি,, সাবেকি;
যখন তোমার দিকে চাই, চোখ আর চোখ নয়,
থরথর কম্পিত হৃদয়।
দুপুরের ছায়া মনে হালকা পর্দা তুলে
তুমি এসে দাঁড়ালে কি পিঠ-ছাওয়া চুলে?
শুধু ভুল ভেঙে দিতে ঘরময় বয়ে গেল বেনামি নিঃশ্বাস।
বাতাসের ঘূর্ণি নাচে বাগানের শুকনো পাতা ওড়ে পথে, পিচে-
তরতর সিঁড়ি বেয়ে সূর্য নামে পশ্চিমের, দোতলার নিচে
মশকের ভারে কুঁজো ভিস্তি, জলোচ্ছ্বাস। ভেজা ঘাস।
যাকে ভুলি, যোজন-যোজন দূরে যে যায় হারিয়ে
তাকে হাতড়িয়ে
আনা ফের স্মৃতির রোদ্দুরে-
অবিকল যেন ফুল হয়ে যাওয়া ভ্রমরের সুরে।
দূরত্বের তটরেখা ব্যাপ্ত জাগরণে
এই চরাচরে- সব ব্যবধান ঘুচে যায় মনে,
জানি ঘুচে যায়
অরণ্য মর্মরে দূরে স্বপ্নের ছায়ায়
একই স্রোতে গ’লে গিয়ে, একই কামনার সুরে ভেসে
দু’দিকের অভিসারী দুই নদী মেশে।
পাখির মতন কেউ বলে-
‘অজস্র তারার ধূলি যাবে শিশিরের জলে
ঘুমহারা জানালার রাত শেষ চলে।
সন্ধ্যার হাটের মেলা ভেঙে গেলে যার
ভয় থাকে কিছু হারাবার
সে-ও অনুরাগে হাত ছোঁয় কত চেনা ও অচেনা
পথিকের-ভোরের স্বপ্নের ডালে।
তুমি আসবে না।
২
পৃথিবী শেখায় বহু তত্ত্বকথা, সব টুকিটাকি
আশ্চর্য খবর জানা যায় গ্রন্থকীট সেজে ব’সে;
যেখানেই থাকি
কোথাও আকাশ থেকে দূরে তারা খ’সে
গেলে টের পাই;
সাংহাই জ্বলেছে কবে, কার চোখে ট্রয় জ্ব’লে পুড়ে হল ছাই,
রুশের বিপ্লবে কারা করতালি পেয়েছে প্রচুর,
জীবনের নানা ছলাকলা আর দূর
আকাশের পরপারে যা রয়েছে লেখা
একদিন সবি যায় শেখা
শিল্পের জটিল সূত্র উন্মীলিত হয়,
রবীন্দ্রনাথের গান সময় সময়
হাওয়া দেয়, হাওয়া দেয় সত্তার গভীরে,
তবু জানি, মেয়ে, এত আলো মেখে মনের তিমিরে
কী আশ্চর্য আজও মনে হয়-
তোমার হাতের স্পর্শ, কপালের টিপ,
তোমার কণ্ঠের মৃদু গুনগুন ধ্বনি, হাসি, কালো
চুল আর অতল চোখের দুটি শিখা দিতে পারে যত আলো
তত আর দেয় নাকো অন্য কোনো জ্ঞানের প্রদীপ।
৩
জানি না রাত্রির কানে কার নাম প্রার্থনার মতো
বলো তুমি ঘন-ঘন অন্ধকার নিঃশ্বাসের স্বরে,
পুবের জানালা খুলে গুনগুন গান গেয়ে শেষে
যখন শয্যায় জ্বলে দেহ, কার মুখ ভেবে-ভেবে
তোমার চোখের হ্রদে নামে সব ঘুমের অপ্সরী,
কার স্বপ্ন দেখে, কার তীব্র চুম্বনের প্রতীক্ষায়
তোমার যুগল স্তন স্বর্গ হয় রাত্রির নরকে;
জানব না কার কোলে মাথা রেখে অন্তিম বিদায়,
শেষ ক্ষমা চেয়ে নেবে পরিচিত পৃথিবীর কাছে
কোন ক্ষণে জানব না কোনো দিন, কোনো দিন তবু।
কাব্যগ্রন্থ: দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০)
নিঃশব্দে নিঃসঙ্গ এই চেনা
বাগানের দরজা খুলে ফাল্গুনের বিহ্বল দুপুরে
মাড়িয়ে ঘাসের পিঁপড়ে, শুকনো পাতা
সিঁড়ির নির্জন বাঁক ঘুরে
এসে শিশিরের মতো স্বেদকণা মুছে মিহি রুমালে,
হাওয়ায় প্রীত তুমি মৃদু টোকা দেবে না দরজায়;
গানের গুঞ্জনে আর উঠবে না ভরে
দক্ষিণের শূন্য ঘর প্রহরে প্রহরে।
যে-চোখে ফুলের ঝাড়, ফলের গুচ্ছের ভার দেখি
সেই চোখ চোখই থাকে অনাদি,, সাবেকি;
যখন তোমার দিকে চাই, চোখ আর চোখ নয়,
থরথর কম্পিত হৃদয়।
দুপুরের ছায়া মনে হালকা পর্দা তুলে
তুমি এসে দাঁড়ালে কি পিঠ-ছাওয়া চুলে?
শুধু ভুল ভেঙে দিতে ঘরময় বয়ে গেল বেনামি নিঃশ্বাস।
বাতাসের ঘূর্ণি নাচে বাগানের শুকনো পাতা ওড়ে পথে, পিচে-
তরতর সিঁড়ি বেয়ে সূর্য নামে পশ্চিমের, দোতলার নিচে
মশকের ভারে কুঁজো ভিস্তি, জলোচ্ছ্বাস। ভেজা ঘাস।
যাকে ভুলি, যোজন-যোজন দূরে যে যায় হারিয়ে
তাকে হাতড়িয়ে
আনা ফের স্মৃতির রোদ্দুরে-
অবিকল যেন ফুল হয়ে যাওয়া ভ্রমরের সুরে।
দূরত্বের তটরেখা ব্যাপ্ত জাগরণে
এই চরাচরে- সব ব্যবধান ঘুচে যায় মনে,
জানি ঘুচে যায়
অরণ্য মর্মরে দূরে স্বপ্নের ছায়ায়
একই স্রোতে গ’লে গিয়ে, একই কামনার সুরে ভেসে
দু’দিকের অভিসারী দুই নদী মেশে।
পাখির মতন কেউ বলে-
‘অজস্র তারার ধূলি যাবে শিশিরের জলে
ঘুমহারা জানালার রাত শেষ চলে।
সন্ধ্যার হাটের মেলা ভেঙে গেলে যার
ভয় থাকে কিছু হারাবার
সে-ও অনুরাগে হাত ছোঁয় কত চেনা ও অচেনা
পথিকের-ভোরের স্বপ্নের ডালে।
তুমি আসবে না।
২
পৃথিবী শেখায় বহু তত্ত্বকথা, সব টুকিটাকি
আশ্চর্য খবর জানা যায় গ্রন্থকীট সেজে ব’সে;
যেখানেই থাকি
কোথাও আকাশ থেকে দূরে তারা খ’সে
গেলে টের পাই;
সাংহাই জ্বলেছে কবে, কার চোখে ট্রয় জ্ব’লে পুড়ে হল ছাই,
রুশের বিপ্লবে কারা করতালি পেয়েছে প্রচুর,
জীবনের নানা ছলাকলা আর দূর
আকাশের পরপারে যা রয়েছে লেখা
একদিন সবি যায় শেখা
শিল্পের জটিল সূত্র উন্মীলিত হয়,
রবীন্দ্রনাথের গান সময় সময়
হাওয়া দেয়, হাওয়া দেয় সত্তার গভীরে,
তবু জানি, মেয়ে, এত আলো মেখে মনের তিমিরে
কী আশ্চর্য আজও মনে হয়-
তোমার হাতের স্পর্শ, কপালের টিপ,
তোমার কণ্ঠের মৃদু গুনগুন ধ্বনি, হাসি, কালো
চুল আর অতল চোখের দুটি শিখা দিতে পারে যত আলো
তত আর দেয় নাকো অন্য কোনো জ্ঞানের প্রদীপ।
৩
জানি না রাত্রির কানে কার নাম প্রার্থনার মতো
বলো তুমি ঘন-ঘন অন্ধকার নিঃশ্বাসের স্বরে,
পুবের জানালা খুলে গুনগুন গান গেয়ে শেষে
যখন শয্যায় জ্বলে দেহ, কার মুখ ভেবে-ভেবে
তোমার চোখের হ্রদে নামে সব ঘুমের অপ্সরী,
কার স্বপ্ন দেখে, কার তীব্র চুম্বনের প্রতীক্ষায়
তোমার যুগল স্তন স্বর্গ হয় রাত্রির নরকে;
জানব না কার কোলে মাথা রেখে অন্তিম বিদায়,
শেষ ক্ষমা চেয়ে নেবে পরিচিত পৃথিবীর কাছে
কোন ক্ষণে জানব না কোনো দিন, কোনো দিন তবু।
কাব্যগ্রন্থ: দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০)
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন