গিন্নির হাতে বানানো পান মুখে দিতে দিতে কর্তা বাবু বললো, “লোডশেডিং যেভাবে দিন দিন বাড়ছে তাতে তো সিদ্ধ হয়ে মরতে হবে অতি শীগ্রই, অতিষ্ট হয়ে পড়েছি, আরতো পারি না। ” কর্তা বাবুর কথা শুনে গিন্নির মুখে একটা স্পস্ট দুঃশ্চিন্তা ছাপ দেখে সাথে সাথে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো হরিপদ। মনে মনে ভাবতে লাগলো এই লোডশেডিং টা কি, যা কর্তা বাবুর মত বড় মানুষকে সিদ্ধ করে দিতে পারে? কর্তা বাবুকেই জিজ্ঞাসা করবে এই “লোডশেডিং” টা কে, কি অথবা আসলো কোথা থেকে? কর্তা বাবুকে প্রশ্ন করতে যেই না মুখ হা করলো হরিপদ, তখনি মনে পরে গেল দিনের প্রারম্ভে কর্তা বাবুর সতর্কবাণী। আজ সকালে কর্তা বাবুকে যখন হরিপদ জিজ্ঞাসা করেছিলো, ” কর্তা, সুবল বললো আগামী শুক্রবার নাকি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে?” তখনই কর্তা তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, আজকে দিনে আর একটা প্রশ্ন করলে নূতন কিনে আনা ছাতাতে তার মেরুদন্ড ভাঙ্গা হবে। মেরুদন্ড বাঁচাতে গিয়ে আর কোনো প্রশ্নই করলো না হরিপদ। বের হয়ে এলো কর্তা বাবুর জমিদার বাড়ি থেকে।
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে হরিপদ হেঁটে চলছে আর ভাবছে, ছোট কালে পিতা মারা যাওয়ার পর এই কর্তা বাবুর বাড়িতেই বড় হয়েছে, কর্তা বাবু তার পিঠে যতই ছাতা ভাঙ্গুক না কেন আহার দিয়েছে ঠিক তিন বেলাই। এখন এই কর্তা বাবু যদি লোডশেডিং এর কবলে পরে সিদ্ধ হয়ে যায় তাহলে তাকে কে আশ্রয় দিবে। দু’কূলে তার কেউই নেই এই কর্তা ছাড়া। ভাবনার অতলে হারিয়ে গেছে হরিপদ।
হরিপদের কাছে হঠাৎ রীতিমত দৌড়ে আসলো সুবল দাস। সুবল দাস হলো হরিপদের একমাত্র বন্ধু। পাশাপাশিই বাড়ি তাদের। দূর থেকে বার কয়েক ডেকে জবাব না পওয়াতে সে দৌড়ে এসেই ধরলো হরিপদকে।
সুবল : “আরে এই হরিপদ, তোরে সেই কতক্ষণ ধরে ডাকছি, কি এমন ভাবছিস যে এত বার পিছন থেকে ডাকার পরও তোর কানে ডাক পৌঁছেনি?”
হরিপদ : ডেকেছিস নাকি? কই শুনতে পাইনি’তো আমি। শুনতে পেলে কি আর থামতাম না বল?
সুবল: এভাবে চিৎকার করে ডাকলাম তারপরও শুনতে পেলি না? নিশ্চই কোনো গভীর ভাবনা ভাবছিলি। কোথা থেকে এলি তুই আর যাচ্ছিস কোথায়?
হরিপদ: এসেছি কর্তা বাড়ি থেকে আর যাচ্ছি একটু রাজমণির বাড়ির দিকে। রাজমণির মায়ের অসুখ তাই আমাকে বলেছিলো কিছু ঔষধ এনে দিতে। কেন ডেকেছিস তুই?
সুবল: আরে আজ রাতে যাত্রা হবে, তোকে নিয়ে রাতে যাত্রা দেখতে যাবো ভাবছি।
হরিপদ: দ্যাঁখ সুবল, কর্তা বাবু যদি শুনে যাত্রা দেখতে গেছি আমি তাহলে নিশ্চিত তার ছাতা আমার পিঠে ভাঙ্গবে। তুই যা আমার দেরী হলে আবার কর্তা চটে যাবে।
এই বলে হরিপদ হাঁটা শুরু করলো। পিছন থেকে সুবল দাস একটু জোর গলায় বললো, “আরে এই হরিপদ যদি যাস তাহলে চলে আসিস।”
হরিপদ একবার পিছনে তাকিয়ে দেখে সুবল হাঁটা শুরু করেছে উল্টোদিকে। দু’কদম সামনে এগিয়েই হঠাৎ হরিপদ থেমে গেলো। পিছনে ফিরে দৌড়ে আসলো সুবল দাসের কাছে। বললো,
হরিপদ: হ্যাঁ সুবল তুই কি সত্যিই আমাকে জোরে জোরে ডেকেছিলি তখন?
সুবল: হ্যাঁ, কেন, তোর বিশ্বাস হয়না? আমি কি মিথ্যে বলেছি নাকি তোর সাথে? ছি, ছি শেষ পর্যন্ত তুই আমারে মিথ্যুক বানালি? কর্তা বাবুর বাড়িতে থাকস বলে কি এখন আমাদের মত গরীবদের কথা তোর বিশ্বাস হয় না’রে হরিপদ?
হরিপদ: আরে না না, কি আজে বাজে কথা শুরু করলি, তোরে আমি মিথ্যুক ভাববো কেন?
সুবল: ঠিকই বলেছিস আমার কথা এখন তোর আজে বাজেই মনে হবে।
হরিপদ: আরে না, কথা শুন প্রথমে। আমি ভাবলাম তুই এতো জোরে ডাকলি কিন্তু আমি শুনতে পেলাম না কেন? আমারও কি তাহলে লোডশেডিং বেড়ে গেলো নাকি?
সুবল: লোডশেডিং!! এই হরিপদ তুই এসব কি কস? এই নামতো জীবনে শুনিনাই।
হরিপদ: কর্তা বাবুর কাছে আজকে শুনেছি, এই লোডশেডিং দিন দিন নাকি বাড়ছে আমাদের দেশে, এটা মানুষকে সিদ্ধ করে ফেলে। কর্তা বাবুও এটা নিয়ে অনেক দুঃশ্চিন্তার মাঝে আছে। ভগবান জানে এখন আমাদের কি হবে। আচ্ছা সুবল, তুই কি কিছু জানিস এই ব্যাপারে?
এই কথা শুনে সুবল একটু আতঙ্কিত হয়ে পরল। গলায় তার কাপুনি ধরেছে। কাঁপতে কাঁপতে বললো,
সুবল: কি কস! এতো দেখি খুব ভয়ংকর কথা রে। আমি জানবো কোথা থেকে? তুই কেন জিজ্ঞাসা করলি না তোর কর্তাকে?
হরিপদ : আরে করতাম আমি কিন্তু সকালে কর্তা বাবু বলেছিলো আজকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে নূতন ছাতাটা দিয়ে আমার মেরুদন্ড ভাঙ্গবে।
সুবল: আরে না, আগামী ছয় মাস আর কোনো ছাতার বারি খাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তুই নিশ্চিন্তে থাক হরিপদ। কর্তা বাবু হয়তো এমনি বলেছে, নূতন ছাতা দিয়ে তোকে মারতে এসে তার ছাতা সে নষ্ট করবে না। ধনীদের কাছে গরীবের মেরুদন্ডের চেয়ে তার নূতন ছাতার মূল্য অনেক বেশি।
হরিপদ: তা ঠিকই বলেছিস তুই সুবল। এর চেয়ে ভাল হবে চল মহাজনের কাছে যাই। উনি বলতে পারবেন আসল ঘটনা কি। কত মানুষের সাথেইতো তার চলাফেরা রয়েছে। আর সেখানে গেলে একটা উপায়ও বেরিয়ে আসবে।
সুবল: হ্যাঁ, যাওয়া যায় খারাপ না কিন্তু মহাজন কি আমাদের কথা শুনবেন? উনিতো খুব বড় মানুষ।
সুবল দাসের কথা শুনে হরিপদের চোখগুলো বড় হয়ে গেলো।
হরিপদ: কি বলিস তুই? উনি আবার বড় মানুষ হলো কবে? তাহলেতো আর তাকে পাওয়া যাবে না।
সুবল: কেন?
হরিপদ: কেন কি? তুই জানিস না, মানুষ বড় হলে তাদেরকে আর পাওয়া যায় না? কেন নারায়ণ চক্রবর্তীর কথা কি ভুলে গেলি? সেই যে ইলেকশনে জিতার পর শহরে গেছে আর কি ফিরে আসছিলো? বড় মানুষ তারাই যাদেরকে দেখা যায় কর্তা বাবুর টেলিভিশনে।
সুবল: তা তুই ঠিকই বলেছিস। এক কাজ কর রাতে কর্তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে চল দুজনে মিলে যাত্রা দেখার আগে মহাজনের কাছে যাবো।
হরিপদ : আরে তুই আছিস শুধু তোর যাত্রা নিয়ে, এই দিকে আমিতো ধীরে ধীরে সিদ্ধ হতে শুরু করেছি। আচ্ছা এখন আমি আগে রাজমণির মা’য়ের ঔষধ কিনে দিয়ে আসি। রাতে কর্তা বাবুর বাড়ি থেকে এসে চিন্তা করবো কি করা যায়।
এই বলে সুবল দাসকে বিদায় জানিয়ে হরিপদ রাজমণির বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে সাথে তার ভাবনার ঘনত্ব বাড়ছে। হঠাৎ ভাবতে লাগলো রাজমণির মায়ের অসুখের কথা। দুপুরে রাজমণি শুধু বলেছিলো তার মায়ের অসুখ কিন্তু কি অসুখ সেটা বলেনি। তার মা’য়ের আবার লোডশেডিং হয়নিতো? এই ভাবনা তার মনে আসার সাথে সাথে প্রায় বিদ্যুৎ গতিতেই ছুটে চললো রাজমণির বাড়ির দিকে।