রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কবি শামসুর রাহমান এর দুটি কবিতা-২

নিরুপমার কাছে প্রস্তাব


বকুলতলায় যাবে? তুমি বড়ো সন্দেহপ্রবণ,
সেখানে, বিশ্বাস করো, সাপখোপ নেই, মাস্তানের
আড্ডা নেই। বিপদের আবর্তে তোমাকে কোনোদিন
ডোবাতে পারি না। পাখি আসে সেখানে এবং
কয়েকটি প্রজাপতি হয়তো-বা। কবিতার বই
ইচ্ছে করলে আনতে পারো, পাশাপাশি পড়বো দু’জন।

সেকেলে টেকেলে যা-ই ভাবো, প্রাণ খুলে যত দুয়ো
দাও আধুনিকা, তবু তোমাকেই বকুলতলায়
নিয়ে যাবো; করো না বারণ। যদি পাখি না-ও ডাকে,
না-ও থাকে এক শিখা ঘাস সেই বকুলতলায়,
তবু নিয়ে যাবো। না, ওভাবে ফিরিয়ে নিও না মুখ,
ভেবো না আমার নেই কালজ্ঞান। বস্তুত আমিও

অনেক উত্তাল দীপ্র মিছিলে শামিল হ’য়ে যাই,
যখন ভিয়েতনামে পড়ে বোমা, আমায় হৃদয়
হয় দগ্ধ গ্রাম মেঘে মেঘে খুনখারাবির চিহ্ন
খুঁজে পাই; উপরন্তু বসন্তের পিঠে ছুরি মেরে
হত্যাকারী সেজে বসে আছি। কেন এ প্রহরে
তোমাকে হঠাৎ দূরে বকুলতলায় যেতে বলি?

বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি।
আমার ভেতর এক দুঃস্বপ্ন-দুনিয়া পরিব্যাপ্ত,
ভয়াল নখরময় প্রাণীকুল অন্তর্গত তন্তু
ছিঁড়ে খুঁড়ে খায় সর্বক্ষণ এবং জীবাশ্মগুলো
জ্যান্ত হয়ে ওঠে ভয়াবহভাবে হঠাৎ কখনো।
বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি।
বকুলতলায় ব্যাপ্ত আমার উধাও শৈশবের
উন্মুখর দিনগুলি, সেই রাঙা পবিত্রতা তোমার সত্তায়
মেখে দিতে চাই। তবু, হে মহিলা, তুমি কি যাবে না?

বদলে ফেলি


আমি যে এই আমির খোলস ছেড়ে ছুঁড়ে যখন তখন
বেরিয়ে আসি,
রৌদ্রেপোড়া জ্যোৎস্না মোড়া এই সমাচার তোমার চেয়ে
ভালো ক’রে কেউ জানে না।
ফুটফুটে খুব সকালবেলা কিংবা ধরো পিতামাতার
বুক-কাঁপানো ঘুম-তাড়ানো ডাগর কোনো মেয়ের মতো
মধ্যরাতে
এই যে আমি ঘরে বাইরে কেমন যেন হ’য়ে উঠি,
তোমার চেয়ে বেশি বলো
কেই বা জানে?

আমাকে এক ভীষণ দানো তাড়িয়ে বেড়ায় অষ্টপ্রহর,
তীব্র খাঁ খাঁ খিদের চোটে আমার মাংস
অস্থি মজ্জা চেটে চুটে হরহামেশা সাবাড় করে।
লকলকানো চুল্লিতে দেয় হেলায় ছুঁড়ে,
অথবা সে অগ্নিমান্দ্যে ভুগলে তখন খামখেয়ালি খেলায় মাতে।
তপস্বী এক বেড়াল সেজে ঘুরে বেড়ায় আশে পাশে
আমার ঘরে।

রাত্রিবেলা অনেক দামী রত্ন স্বরূপ দু’চোখ জ্বেলে
আঁধার লেপা চুপ উঠোনে কিংবা কৃপণ বারান্দাটায়
আলস্যময় কোমল পশুর গন্ধ বিলায়
এবং আমি ইঁদুর যেন।
আবার কখন রুক্ষ মরু চতুর্ধারে জ্বলতে থাকে,
বুকের ভেতর শুশুনিয়া, হাতড়ে বেড়াই জলের ঝালর;
মুখের তটে ঝরে শুধুই তপ্ত বালি; কখনো-বা পায়ের নিচে
বেজে ওঠে বেগানা হাড়।
এই যে এমন দৃশ্যাবলি উদ্ভাসিত যখন তখন,
তুমি ছাড়া কেউ দেখে না।
হঠাৎ দেখি, মুখোশ-পরা আবছা মানুষ দু-রঙা ঐ
ঘুঁটিগুলো সামনে রেখে বললো এসে,
‘তোমার সঙ্গে খেলবো পাশা।
জনবিহীন জাহাজ-ডেকে দ্যুতক্রীড়ায় মত্ত দু’জন
ডাকিনীদের নিশাস হয়ে বাতাস ফোঁসে চতুর্দিকে,
মাঝে মধ্যে চোখে-মুখে ঝাপ্টা লাগে লোনা পানির।
প্রতিযোগীর শীর্ণ হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎ চমকে উঠি,
যেন আমি ইলেকট্রিকের শক পেয়েছি অন্ধকারে।
প্রতিযোগী কিতাব নিসাড়, নীল-শলাকা আঙুলগুলো
দারুণ শীতে মৃত কোনো সাপের মতো ঠাণ্ড এতো-
শিউরে উঠি।
মুখোশধারীর চক্ষু তো নেই, শুধুই ধু ধু যুগ্ম কোটর।

ভীষণ দানো দুরন্ত সেই পেলব বেড়াল এবং কালো
মুখোশ-পরা আবছা মানুষ আসলে সব

তুমিই জানি।
ভূমন্ডলে তোমার চেয়ে চমকপ্রদ চতুর কোনো বহুরূপী
কে-ই বা আছে?

আপন কিছু স্বপ্ন তোমায় বাট্রা দিয়ে খাট্রা মেজাজ
শরীফ করি।
তোমার জন্যে টুকরো টুকরো সত্তাটাকে নিংড়ে নিয়ে
রূপান্তরের গভীরে যাই কখনো বা কেবল চলি।
জানিনা হায়, সামনে কী-যে আছে পাতা-
ফুল্ল কোনো মোহন রাস্তা কিংবা বেজায় অন্ধ গলি।
তোমার জন্যে সকাল সন্ধ্যা নিজেকে খুব বদলে ফেলি,
অন্তরালে বদলে ফেলি।

তোমার জন্যে চড়ুই হয়ে চঞ্চু ঘষি শ্বেত পাথরে,
কখনো ফের স্বর্ণচাঁপায় এক নিমিষে হই বিলীন।
কখনো বা পিঁপড়ে হ’য়ে দুর্গ বানাই ব্যস্তবাগীশ
ছুটে বেড়াই দেয়াল পাড়ায়।

তোমার জন্যে হই শহুরে শীর্ণ কুকুর, দীর্ণ বুকে গাড্ডা থেকে
পান করি জল;

তোমার জন্যে হই আসামী ফাঁসির এবং নোংরা সেলে
ব’সে ব’সে নিষিদ্ধ ঐ বহর্জীবন নিয়ে কেমন জ্বরের ঘোরে
উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখি, ক্বচিৎ কোনো শব্দ শুনি।
তোমার জন্যে যখন তখন নিজেকে খুব বদলে ফেলি, আমূল আমি
বদলে ফেলি।

কাব্যগ্রন্থ: আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি (১৯৭৪) 

0 মন্তব্য:

Facebook Comments by প্রহেলিকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by প্রহেলিকা