রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

কবি শামসুর রাহমান এর দুটি কবিতা-১

প্রচ্ছন্ন একজন

ভরাট দুপুর আর নিশুতি রাত্তির নিয়ে বুকে
প্রত্যহ সে করে চলাফেরা
আশেপাশে, কথোপকথনে মাতে পথ ঘাটে যদি
ইচ্ছে হয় শুধায় কুশল পাত্রমিত্রদের। কখনো সখনো
তাকে যায় দেখা রেললাইনে, কখনো ডোবার ধারে
কাটায় ঘন্টার পর ঘন্টা, কী যেন অধীর দেখে নিস্তরঙ্গ
জরৎ সবুজ জলে, আঙুলে বসন্ত নিয়ে কখনো চালায়
ব’সে মাপে অন্ধকার, জ্যোৎস্না, কখনো-বা
ল্যাস্পপোস্টে ব’সে থাকে দু’হাত বাড়িয়ে
আকাশের দিকে, যেন নেবে করতলে
চমৎকার আসমানী পণ্য-
চাঁদের ভগ্নাংশ, নক্ষত্রের ফুলকি অথবা নীলিমা
যা’ পড়ে পড়ুক।

ঘরে এসে ঢুকলেই দ্যাখে চার দেয়ালের একটাও
নেই কাছেধারে, ছাদ মেঘ হয়ে ভাসে, ‘ঘর তবুতো ঘর”
ব’লে সে গভীর নিদ্রা যায় নগ্ন উদার মেঝেতে।
স্বপ্নের চাতালে।

লাল বল অতিশয় চপল এবং
সবুজ পুষ্পতি ট্রেন বাজায় বিদায়ী বাঁশি, ট্রাফিক পুলিশ
চিনির পুতুল হয়ে দিকদর্শী অত্যন্ত নিপুণ।

সে ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে, যখন ভারিক্কী এক
কাকাতুয়া আপিসের বড় কর্মকর্তার ধরনে।

কার্যকারণের

হদিশ খুঁজতে গিয়ে বেজায় গলদঘর্ম হন।
নিদ্রাল শিয়রে ব’সে পাখি বলে এ কেমন টেঁটিয়া মানুষ,
কেমন দুনিয়াছাড়া ঘুমোচ্ছে নিটোল কী-যে, যেন
চতুর্ধারে নেই কোনো বালা মুসিবৎ।
সে ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে, ভীষণ স্তম্ভিত পোকা ও মাকড়।

ফিরে যাও

ফিরে যাও আমার দুয়ার থেকে তোমরা এখন
ফিরে যাও; কিছুতেই তোমাদের দেবো না মাড়াতে
আমার চৌকাঠ! তোমরাতো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে
নিরুদ্দেশ যাত্রায় দিয়েছো পাড়ি কতো না সমুদ্র
অথবা বীরভূমে ধু ধু হয়েছো তৃষ্ণার জল তাঁর
প্রহরে প্রহরে আর নজরুল জ্যৈষ্ঠের দুরন্ত
মেঘের মতন বাবরি দুলিয়ে মোহন বলাৎকার
করেছেন তোমাদের ওপর প্রত্যহ। কবেকার।

জীবনানন্দের জন্যে চকিতে করেছো উন্মোচন
করুণ শঙ্খের মতো স্তন এবং সুধীন্দ্র দত্ত
নিখিল নাস্তির মৌনে ডুবে তোমাদের নাভিমূলে
যৌনাঙ্গের অগভীর কেশে রেখেছেন মুখ ভুলতে
মনস্তাপ। তোমরাতো সাজিয়েছো বিষ্ণুদে’র ঘর
রাত্রিদিন, দিয়েছো সন্ধ্যায় তুলে শ্বেত বাহু মুখ।
এখনো তো বুদ্ধদেব বসুর শয্যায় তোমাদের
ব্রার টুক্‌রো সিঁদুরের রঙ প’ড়ে থাকে ইতস্তত।

ফিরে যাও, আমার দুয়ার থেকে ধিক্কার কুড়িয়ে
ফিরে যাও। তোমাদের চোখে তুলে রাখবার ইচ্ছে
মৃত টিকটিকি হ’য়ে আছে, বুকে নেবো না উৎফুল্ল।
বলে দিচ্ছি, ছলাকলা ব্যর্থ হবে; বিসমিল্লাহ খান
যতই বাজান তাঁর পুষ্পিত সানাই, তোমাদের
হাত ধ’রে আনবো না বাসরে কখনো। তোমরাতো
উচ্ছিষ্ট উর্বশী; ফিরে যাও, ফিরে যাও, যদি পারো
নতুন পাতার মতো সজীব শিহর নিয়ে এসো।

কাব্যগ্রন্থ: আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি (১৯৭৪)

0 মন্তব্য:

Facebook Comments by প্রহেলিকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by প্রহেলিকা