তুমি আসবে না
নিঃশব্দে নিঃসঙ্গ এই চেনা
বাগানের দরজা খুলে ফাল্গুনের বিহ্বল দুপুরে
মাড়িয়ে ঘাসের পিঁপড়ে, শুকনো পাতা
সিঁড়ির নির্জন বাঁক ঘুরে
এসে শিশিরের মতো স্বেদকণা মুছে মিহি রুমালে,
হাওয়ায় প্রীত তুমি মৃদু টোকা দেবে না দরজায়;
গানের গুঞ্জনে আর উঠবে না ভরে
দক্ষিণের শূন্য ঘর প্রহরে প্রহরে।
সংজ্ঞাহীন এক প্রেম
অলিখিত প্রত্যশায় বেনামী স্বপ্নের যে বাগান গড়েছি,
তার নিঃসঙ্গ দেয়াল পেড়িয়ে
বেখেয়ালে মাড়িয়ে ঘাসের শিশির চলে এসো,
মৃত্যু ফুটিয়ে অপেক্ষার; কোন এক পোয়াতি আঁধারে-
নিঃসংকোচে গ্রহন করো
নিবিড় পরিচর্যায় লালিত অনুক্ত শব্দের মালিকানা।
শেষ চরণ
>বাকহীন বৃক্ষের তৃষ্ণার্ত ছাঁয়া জানে
জানে বুকে শয্যা পাতা নিখাদ ধুলো,
কতবার গিয়েছি ছুটে প্রাচীন পথে
বেলা অবেলায় বিদ্রুপের ধুম্রজালে।
বকুলতলায় যাবে? তুমি বড়ো সন্দেহপ্রবণ, সেখানে, বিশ্বাস করো, সাপখোপ নেই, মাস্তানের আড্ডা নেই। বিপদের আবর্তে তোমাকে কোনোদিন ডোবাতে পারি না। পাখি আসে সেখানে এবং কয়েকটি প্রজাপতি হয়তো-বা। কবিতার বই ইচ্ছে করলে আনতে পারো, পাশাপাশি পড়বো দু’জন।
সেকেলে টেকেলে যা-ই ভাবো, প্রাণ খুলে যত দুয়ো দাও আধুনিকা, তবু তোমাকেই বকুলতলায় নিয়ে যাবো; করো না বারণ। যদি পাখি না-ও ডাকে, না-ও থাকে এক শিখা ঘাস সেই বকুলতলায়, তবু নিয়ে যাবো। না, ওভাবে ফিরিয়ে নিও না মুখ, ভেবো না আমার নেই কালজ্ঞান। বস্তুত আমিও
অনেক উত্তাল দীপ্র মিছিলে শামিল হ’য়ে যাই, যখন ভিয়েতনামে পড়ে বোমা, আমায় হৃদয় হয় দগ্ধ গ্রাম মেঘে মেঘে খুনখারাবির চিহ্ন খুঁজে পাই; উপরন্তু বসন্তের পিঠে ছুরি মেরে হত্যাকারী সেজে বসে আছি। কেন এ প্রহরে তোমাকে হঠাৎ দূরে বকুলতলায় যেতে বলি?
বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি। আমার ভেতর এক দুঃস্বপ্ন-দুনিয়া পরিব্যাপ্ত, ভয়াল নখরময় প্রাণীকুল অন্তর্গত তন্তু ছিঁড়ে খুঁড়ে খায় সর্বক্ষণ এবং জীবাশ্মগুলো জ্যান্ত হয়ে ওঠে ভয়াবহভাবে হঠাৎ কখনো। বহুকাল হলো আমি অতিশয় নষ্ট হয়ে গেছি। বকুলতলায় ব্যাপ্ত আমার উধাও শৈশবের উন্মুখর দিনগুলি, সেই রাঙা পবিত্রতা তোমার সত্তায় মেখে দিতে চাই। তবু, হে মহিলা, তুমি কি যাবে না?
বদলে ফেলি
আমি যে এই আমির খোলস ছেড়ে ছুঁড়ে যখন তখন বেরিয়ে আসি, রৌদ্রেপোড়া জ্যোৎস্না মোড়া এই সমাচার তোমার চেয়ে ভালো ক’রে কেউ জানে না। ফুটফুটে খুব সকালবেলা কিংবা ধরো পিতামাতার বুক-কাঁপানো ঘুম-তাড়ানো ডাগর কোনো মেয়ের মতো মধ্যরাতে এই যে আমি ঘরে বাইরে কেমন যেন হ’য়ে উঠি, তোমার চেয়ে বেশি বলো কেই বা জানে?
আমাকে এক ভীষণ দানো তাড়িয়ে বেড়ায় অষ্টপ্রহর, তীব্র খাঁ খাঁ খিদের চোটে আমার মাংস অস্থি মজ্জা চেটে চুটে হরহামেশা সাবাড় করে। লকলকানো চুল্লিতে দেয় হেলায় ছুঁড়ে, অথবা সে অগ্নিমান্দ্যে ভুগলে তখন খামখেয়ালি খেলায় মাতে। তপস্বী এক বেড়াল সেজে ঘুরে বেড়ায় আশে পাশে আমার ঘরে।
রাত্রিবেলা অনেক দামী রত্ন স্বরূপ দু’চোখ জ্বেলে আঁধার লেপা চুপ উঠোনে কিংবা কৃপণ বারান্দাটায় আলস্যময় কোমল পশুর গন্ধ বিলায় এবং আমি ইঁদুর যেন। আবার কখন রুক্ষ মরু চতুর্ধারে জ্বলতে থাকে, বুকের ভেতর শুশুনিয়া, হাতড়ে বেড়াই জলের ঝালর; মুখের তটে ঝরে শুধুই তপ্ত বালি; কখনো-বা পায়ের নিচে বেজে ওঠে বেগানা হাড়। এই যে এমন দৃশ্যাবলি উদ্ভাসিত যখন তখন, তুমি ছাড়া কেউ দেখে না। হঠাৎ দেখি, মুখোশ-পরা আবছা মানুষ দু-রঙা ঐ ঘুঁটিগুলো সামনে রেখে বললো এসে, ‘তোমার সঙ্গে খেলবো পাশা। জনবিহীন জাহাজ-ডেকে দ্যুতক্রীড়ায় মত্ত দু’জন ডাকিনীদের নিশাস হয়ে বাতাস ফোঁসে চতুর্দিকে, মাঝে মধ্যে চোখে-মুখে ঝাপ্টা লাগে লোনা পানির। প্রতিযোগীর শীর্ণ হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎ চমকে উঠি, যেন আমি ইলেকট্রিকের শক পেয়েছি অন্ধকারে। প্রতিযোগী কিতাব নিসাড়, নীল-শলাকা আঙুলগুলো দারুণ শীতে মৃত কোনো সাপের মতো ঠাণ্ড এতো- শিউরে উঠি। মুখোশধারীর চক্ষু তো নেই, শুধুই ধু ধু যুগ্ম কোটর।
ভীষণ দানো দুরন্ত সেই পেলব বেড়াল এবং কালো মুখোশ-পরা আবছা মানুষ আসলে সব
তুমিই জানি। ভূমন্ডলে তোমার চেয়ে চমকপ্রদ চতুর কোনো বহুরূপী কে-ই বা আছে?
আপন কিছু স্বপ্ন তোমায় বাট্রা দিয়ে খাট্রা মেজাজ শরীফ করি। তোমার জন্যে টুকরো টুকরো সত্তাটাকে নিংড়ে নিয়ে রূপান্তরের গভীরে যাই কখনো বা কেবল চলি। জানিনা হায়, সামনে কী-যে আছে পাতা- ফুল্ল কোনো মোহন রাস্তা কিংবা বেজায় অন্ধ গলি। তোমার জন্যে সকাল সন্ধ্যা নিজেকে খুব বদলে ফেলি, অন্তরালে বদলে ফেলি।
তোমার জন্যে চড়ুই হয়ে চঞ্চু ঘষি শ্বেত পাথরে, কখনো ফের স্বর্ণচাঁপায় এক নিমিষে হই বিলীন। কখনো বা পিঁপড়ে হ’য়ে দুর্গ বানাই ব্যস্তবাগীশ ছুটে বেড়াই দেয়াল পাড়ায়।
তোমার জন্যে হই শহুরে শীর্ণ কুকুর, দীর্ণ বুকে গাড্ডা থেকে পান করি জল;
তোমার জন্যে হই আসামী ফাঁসির এবং নোংরা সেলে ব’সে ব’সে নিষিদ্ধ ঐ বহর্জীবন নিয়ে কেমন জ্বরের ঘোরে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখি, ক্বচিৎ কোনো শব্দ শুনি। তোমার জন্যে যখন তখন নিজেকে খুব বদলে ফেলি, আমূল আমি বদলে ফেলি।
ভরাট দুপুর আর নিশুতি রাত্তির নিয়ে বুকে প্রত্যহ সে করে চলাফেরা আশেপাশে, কথোপকথনে মাতে পথ ঘাটে যদি ইচ্ছে হয় শুধায় কুশল পাত্রমিত্রদের। কখনো সখনো তাকে যায় দেখা রেললাইনে, কখনো ডোবার ধারে কাটায় ঘন্টার পর ঘন্টা, কী যেন অধীর দেখে নিস্তরঙ্গ জরৎ সবুজ জলে, আঙুলে বসন্ত নিয়ে কখনো চালায় ব’সে মাপে অন্ধকার, জ্যোৎস্না, কখনো-বা ল্যাস্পপোস্টে ব’সে থাকে দু’হাত বাড়িয়ে আকাশের দিকে, যেন নেবে করতলে চমৎকার আসমানী পণ্য- চাঁদের ভগ্নাংশ, নক্ষত্রের ফুলকি অথবা নীলিমা যা’ পড়ে পড়ুক।
ঘরে এসে ঢুকলেই দ্যাখে চার দেয়ালের একটাও নেই কাছেধারে, ছাদ মেঘ হয়ে ভাসে, ‘ঘর তবুতো ঘর” ব’লে সে গভীর নিদ্রা যায় নগ্ন উদার মেঝেতে। স্বপ্নের চাতালে।
লাল বল অতিশয় চপল এবং সবুজ পুষ্পতি ট্রেন বাজায় বিদায়ী বাঁশি, ট্রাফিক পুলিশ চিনির পুতুল হয়ে দিকদর্শী অত্যন্ত নিপুণ।
সে ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে, যখন ভারিক্কী এক কাকাতুয়া আপিসের বড় কর্মকর্তার ধরনে।
কার্যকারণের
হদিশ খুঁজতে গিয়ে বেজায় গলদঘর্ম হন। নিদ্রাল শিয়রে ব’সে পাখি বলে এ কেমন টেঁটিয়া মানুষ, কেমন দুনিয়াছাড়া ঘুমোচ্ছে নিটোল কী-যে, যেন চতুর্ধারে নেই কোনো বালা মুসিবৎ। সে ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে, ভীষণ স্তম্ভিত পোকা ও মাকড়।
ফিরে যাও
ফিরে যাও আমার দুয়ার থেকে তোমরা এখন ফিরে যাও; কিছুতেই তোমাদের দেবো না মাড়াতে আমার চৌকাঠ! তোমরাতো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নিরুদ্দেশ যাত্রায় দিয়েছো পাড়ি কতো না সমুদ্র অথবা বীরভূমে ধু ধু হয়েছো তৃষ্ণার জল তাঁর প্রহরে প্রহরে আর নজরুল জ্যৈষ্ঠের দুরন্ত মেঘের মতন বাবরি দুলিয়ে মোহন বলাৎকার করেছেন তোমাদের ওপর প্রত্যহ। কবেকার।
জীবনানন্দের জন্যে চকিতে করেছো উন্মোচন করুণ শঙ্খের মতো স্তন এবং সুধীন্দ্র দত্ত নিখিল নাস্তির মৌনে ডুবে তোমাদের নাভিমূলে যৌনাঙ্গের অগভীর কেশে রেখেছেন মুখ ভুলতে মনস্তাপ। তোমরাতো সাজিয়েছো বিষ্ণুদে’র ঘর রাত্রিদিন, দিয়েছো সন্ধ্যায় তুলে শ্বেত বাহু মুখ। এখনো তো বুদ্ধদেব বসুর শয্যায় তোমাদের ব্রার টুক্রো সিঁদুরের রঙ প’ড়ে থাকে ইতস্তত।
ফিরে যাও, আমার দুয়ার থেকে ধিক্কার কুড়িয়ে ফিরে যাও। তোমাদের চোখে তুলে রাখবার ইচ্ছে মৃত টিকটিকি হ’য়ে আছে, বুকে নেবো না উৎফুল্ল। বলে দিচ্ছি, ছলাকলা ব্যর্থ হবে; বিসমিল্লাহ খান যতই বাজান তাঁর পুষ্পিত সানাই, তোমাদের হাত ধ’রে আনবো না বাসরে কখনো। তোমরাতো উচ্ছিষ্ট উর্বশী; ফিরে যাও, ফিরে যাও, যদি পারো নতুন পাতার মতো সজীব শিহর নিয়ে এসো।
আড়ালেই থাকি, ত্রস্ত সর্বদাই; ব্যস্ত ভিড় ঠেলে কবুই ভরসা ক’রে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়া আজো হলো না আমার। পাদপ্রদীপের আলো কোনোদিন পড়বে না মুখে জানি। তা ব’লে ভাগ্যের কথা তুলে বারোমাস কাউকে দিই না দোষ। হাটে মাঠে নয়, মৃদু আলো-আঁধারিতে গৃহকোণে একা একা কাটে
প্রায়শ আমার বেলা। খেয়ালের বশে বাস্তবের সঙ্গে খেলি কানামাছি-লেখার টেবিলে অকস্মাৎ দেখে ফেলি ডোরাকাটা উদ্দাম জেব্রার দল কিংবা গন্ডারের একরোখা দৌড়, কখনো লেগুন নম্র ওঠে জেগে আদিম জলের মায়া নিয়ে। স্নানার্থিনী কটি থেকে দেয় ছেড়ে প্রাচীন বাকল, প্রেমবিদ্ধ বংশীবাদকের সুরে পাথর, মরাল আসে ছুটে, সিংহ আর মেষ থাকে শুয়ে পাশাপাশি, কখনো বা জিরাফ বাড়ায় গলা বইয়ের পাহাড় ফুঁড়ে, দেখি বারংবার টেবিলের ইন্দ্রজালঃ ট্রয়ের প্রাচীর শালের ঘর্মাক্ত আলোয় বড়ো বেশি নিঃস্ব, যেন প্রেতপুরী; এক কোণে বাংলার মাটিলে ঘর প্রস্ফুটিত, অন্যদিকে পদ্যাক্রান্ত নিশি-পাওয়া কাফে।
বইয়ের পাতায় খুঁজি মুক্তির সড়ক বদ্ধ ঘরে প্রত্যহ, তত্ত্বের ঢক্কা নিনাদে কখনো কানে মনে লাগে তালা; অহর্নিশ মননের রৌদ্রজলে বাঁচা সার্থক মেনেছি, তবু জানি সারাক্ষণ দর্শনের গোলক ধাঁধায় ঘুরে তথ্যের খড়-বিচালি ঘেঁটে ক্লান্ত লাগে, বুদ্ধির সম্রাট ভয়ানক মুখোশের আড়ালে প্রচ্ছন্ন থেকে হানেন সন্ত্রাস। বাস্তবিক মননে থাকলে মেতে সর্বদা অথবা শিল্পে ম’জে রইলে অগোচরে মনে জটিল অরণ্য জেগে ওঠে, জীবন-বিরোধী শ্বাপদের খুরে মগজের কোষ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। তাই বদ্ধ ঘর ছেড়ে দূরে মাঝে-মধ্যে যাওয়া ভালো, ভালো সূর্যাস্তের স্তবময় টিলায়, নদীর শান্ত বাঁকে যাওয়া। তবে মননেও খেলবে উদার হাওয়া, শিল্প হবে দীপ্র, মানবিক।
তোমার অমন ভবিষ্যময় চোখে তাকালেই পারমাণবিক ভস্ম আমাকে করে দ্রুত গ্রাস হাতড়ে হাতড়ে কোনো সূত্রের পাই না যে খেই, পায়ের তলায় মাটি অস্থির, বর্বিত ত্রাস।
দোহাই তোমার এক্ষুণি ফের খুলোনা এ মুখ। ফস ক’রে তুমি কী যে ব’লে দেবে, দেয়ালের দিকে তর্জনী তুলে স্তোত্র পাঠের উদাত্ত সুখ চোখে নেবে কিছু হয়তো আনবে কাল-রাত্রিকে।
তোমার ভীষণ ভাবী কথনের নেই কোনো দাম মাঠে কি পার্কে, কলোনীতে, মেসে, গলির গুহায়। আত্মাকে ঢেকে খবর-কাগজে যারা অবিরাম প্রমত্ত তারা দেয়ালে কিছুই দেখে না তো, হায়।
অন্যে বুঝুক না বুঝুক আমি জানি ঐ ঠোঁট নড়লেই কালবৈশাখী দেবে দিগন্তে হানা, প্রলয়ের সেনা গোপনে বাঁধবে নির্দয় জোট হত্যার সাথে, ঝাপটাবে খুব নিয়তির ডানা।
তুমি বলেছিলে, জননী তোমার কুক্কুরী-রূপ পাবে একদিন, জনক সর্বনাশের বলয়ে ঘুরপাক খেয়ে হবেন ভীষণ একা, নিশ্চুপ; নগরে ধ্বনিত হবে শোকগীতি লম্বিত লয়ে। দেবতা তোমার জিহ্বায় কেমন অভিশাপ ঘিরে দিয়েছেন, তার ছায়ায় প্রতিটি গহন উক্তি ধ্বংস রটায় আধা-মনস্ক মানুষের ভিড়ে খুলবে না মুখ-এলো করি এই চরম চুক্তি।
সকল সময় নয়, কোনো কোনো মুহূর্তে হঠাৎ তোমাকে হাওয়ার পাই, পাই সিগারেটের ধোঁয়ায়। কখনো দরজা খুলে দাঁড়ালেই স্মিত অন্ধকারে, কখনো বা সুরভিত বারান্দায় মৃদু চন্দ্রলোকে, গোলাপের অন্তঃপুরে, কখনো সড়কে, মৃত্যু আর জীবনের গুঞ্জরণময় হাসপাতালের বেডে সহসা তোমাকে দেখি। গাছগাছালির অন্তরালে মেঘের উড্ডীন দ্বীপে, এমন কি গোষ্পদেও তুমি।
তুমি এলে আমার চৌদিকে অবলীলাক্রমে দৃশ্য কেবলি পাল্টাতে থাকে, তুমি এলে হাজার হাজার নক্ষত্রের তোড়া আমার সম্মুখে দীপ্র উপস্থিত, সুনীল সমুদ্র ওঠে দুলে, দিগন্তের পাড় চিরে উদ্ভাসিত জাহাজের গর্বিত মাস্তুল; নীল জলে কুহকের কেশপাশ, জাগে প্রতিধ্বনিময় দ্বীপ।
কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার? হাতে জপমালা নেই, তবু আমি তো তোমার নাম মন্ত্রের মতন করি উচ্চারণ সর্বক্ষণ। যেখানে তোমার ছায়া স্বপ্নিল বিলাসে অপূর্ব লুটিয়ে পড়ে, সেখানে আমার ওষ্ঠ রেখে অনেক আলোকবর্ষ যাপন করতে পারি, তোমারই উদ্দেশে সাঁতার না জেনেও নিঃশঙ্ক দ্বিধাহীন গহন নদীতে নেমে যেতে পারি। তোমার সন্ধানে ক্রোশ ক্রোশ দাউ দাউ পথ হেঁটে অগ্নিশুদ্ধ হতে পারি, পারি বুকের শোণিতে ফুল ফোটাতে পাষাণে। যখন পাথরে হাত রাখি, পাথর থাকে না আর অরূপ পাথর, হয়ে যায় প্রতিমা তোমার। যখন বৃক্ষের দিকে দৃষ্টি মেলে দিই, বৃক্ষ হয় তোমার শরীর। প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায় এক বুক উপদ্রব নিয়ে থাকি, ব্যাকুলতা বারবার সিঁদ কেটে ঢোকে, হৃদয়ের ঘরগেরস্থালি, বনস্থলী
লুট হয়ে যায় প্রত্যহ তোমার প্রতীক্ষায়, আমি তাই তুমি ছাড়া কারুর জন্যেই পারি না অপেক্ষা করতে আর।
ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়েছি তোমার ওষ্ঠজাম, তুমি না থাকলে আমার সকল চুমো যাবে বনবাসে, তোমার অমন হাত স্পর্শ ক’রে ছুঁয়েছি স্বর্গের
মল্লিকাকে, তুমি চ’লে গেলে আমার ছোঁয়ার মতো অন্য কোনো হাত থাকবে না আর। এর পরও অনুরাগ নিক্তিতে মাপতে চাও, চাও আমার পরীক্ষা নিতে নানা অছিলায়?
আর কি ভোগ চাও? এক একে নির্দ্বিধায় সবি তো দিয়েছি। হৃদয়ের আসবাবপত্তর সবি তো স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিতে চাই, তবু কেন যাবতীয় সম্পদ আমার ক্রোক করবে বলে নিত্য আমাকে শাসাও? আমি তো তোমাকে সুখ দিতে চয়ে কেবলি নিজের অসুখ বাড়াই।
মাটি ছুঁয়ে বলছি এখন, এই বৃক্ষমূলে আমি শীর্ণ হই, অন্ন আনি নিজে, কান্নায় ধোওয়াই পদযুগ। কী পরীক্ষা নেবে তুমি আর বারবার? আমার সম্মুখে তুলে ধরো বিষপাত্র, নিষ্পলক দ্বিধাহীন নিমেষে উজাড় করে দেবো।
বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলিঃ দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো? বৃক্ষ বলে, আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায় যদি মিশে যেতে পারো, তবে হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।
জীর্ণ দেয়ালের কানে বলিঃ দেয়াল আমাকে তুমি একটি কবিতা দিতে পারো? পুরোনো দেয়াল বলে শ্যাওলা-ঢাকা স্বরে, এই ইট সুরকির ভেতর যদি নিজেকে গুঁড়িয়ে দাও, তবে হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।
একজন বৃদ্ধের নিকটে গিয়ে বলি, নতজানু, হে প্রাচীন দয়া ক’রে দেবেন কি একটি কবিতা? স্তব্ধতার পর্দা ছিঁড়ে বেজে ওঠে প্রাজ্ঞ কণ্ঠ- যদি আমার মুখের রেখাবলী তুলে নিতে পারো নিজের মুখাবয়বে, তবে হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।
কেবল কয়েক ছত্র কবিতার জন্যে এই বৃক্ষ, জরাজীর্ণ দেয়াল এবং বৃদ্ধের সম্মুখে নতজানু আমি থাকবো কতোকাল? বলো, কতোকাল?
অমন তাকাও যদি একবিন্দু অনন্তের মতো চোখ মেলে, আমি বারবার তোমার দিকেই ছুটে আসবো প্রত্যহ।
যেখানে তোমার দৃষ্টি নেই, তোমার পায়ের ছাপ পড়ে না যেখানে কেনোদিন সেখানে কী করে থাকি? তোমাকে দেখার জন্যে আমি যশের মুকুট ছুঁড়ে দেবো ধূলায় হেলায়, তাকাবো না ফিরে ভুলে কস্মিনকালেও আর। মেনে নেবো হার, এই খর মধ্যাহ্নেই হয়ে যাবো স্বেচ্ছায় সূর্যাস্ত; জেনে রাখো, তোমাকে দেখার জন্যে বেহেস্তী আঙুর আর কয়েক ডজন হুরীর লালচ আমি সামলাতে পারবো নিশ্চিত।
তোমার নিদ্রার ঢেউয়ে ঢেউয়ে যাবো বেয়ে ছিপ নৌকো এবং লাফিয়ে প’ড়ে তোমার স্বপ্নের তটে আবিষ্কারকের মতো দেবো পুঁতে আমার নিঃশ্বাসে আন্দোলিত এক পবিত্র নিশান।
কখনো নিদ্রার রাজপথে, কখনো-বা জাগরণে বাগানে কি পার্কে সড়কে ট্রাফিক দ্বীপে, বাসে গোলাপ শ্লোগান হাঁকে একরাশ, উড়ন্ত কপোত অকস্মাৎ দিগ্বিদিক লুটোয় নিষিদ্ধ ইস্তাহার হ’য়ে, পড়ি, ‘নরকেও ভালোবাসা ম্যানিফেস্টো হিরন্ময়। অমন দাঁড়াও যদি নিরিবিলি পা রেখে চৌকাঠে, সমর্পণ করতে পারি আমার সমস্ত আয়ুষ্কাল তোমারই আঁচলে। যদি পাপ তোমার শরীর হ’য়ে নত নয়, হয় উন্মোচিত, দ্বিধাহীন তাকে খাবো চুমো গাঢ়, বাঁধবো ব্যাকুল আলিঙ্গনে।
অজস্র জন্ম ধরে
আমি তোমার দিকে আসছি
কিন্তু পৌঁছুতে পারছি না।
তোমার দিকে আসতে আসতে
আমার এক একটা দীর্ঘ জীবন ক্ষয় হয়ে যায়
পাঁচ পঁয়সার মোম বাতির মত।
আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিলো
শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে,
এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।
আমার দুঃখ,
তোমার স্বপ্ন দেখার জন্যে
আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম।
আরেক জন্মে
আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরেছিলাম তোমার উদ্দেশ্য।
পথে বেরিয়েই আমি পলি মাটির উপর আকাঁ দেখি
তোমার পায়ের দাগ
তার প্রতিটি রেখা
আমাকে পাগল করে তোলে।
ঐ আলতার দাগ,আমার চোখ,আর বুক আর স্বপ্নকে
এতো লাল করে তুলে,
যে আমি তোমাকে সম্পূর্ন ভুলে যাই
ঐ রঙ্গীন পায়ের দাগ প্রদক্ষীন করতে করতে
আমার ঐ জন্মটা কেটে যায়।
আমার দুঃখ !
মাত্র একটি জন্ম
আমি পেয়েছিলাম
সুন্দর কে প্রদক্ষীন করার।
আরেক জন্মে
তোমার কথা ভাবতেই-
আমার বুকের ভিতর থেকে সবচে দীর্ঘ
আর কোমল,আর ঠাণ্ডা নদীর মত
কি যেন প্রবাহিত হতে শুরু করে।
সেই দীর্ঘশ্বাসে তুমি কেঁপে উঠতে পারো ভেবে
আমি একটা মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে
কাটিয়ে দেই সম্পুর্ন জন্মটা।
আমার দুঃখ ,আমার কোমলতম দীর্ঘশ্বাসটি ছিল
মাত্র এক জন্মের সমান দীর্ঘ
আমার ষোঁড়শ জন্মে
একটি গোলাপ আমার পথ রোধ করে,
আমি গোলাপের সিঁড়ি বেয়ে তোমার দিকে উঠতে থাকি-
উঁচুতে ! উঁচুতে !! আরো উঁচুতে !!!
আর এক সময় ঝড়ে যাই চৈত্রের বাতাসে।
আমার দু:খ মাত্র একটি জন্ম
আমি গোলাপের পাপঁড়ি হয়ে
তোমার উদ্দেশ্য ছড়িয়ে পরতে পেরেছিলাম।
এখন আমার সমস্ত পথ জুড়ে
টলমল করছে একটি অশ্রু বিন্দু।
ঐ অশ্রু বিন্দু পেরিয়ে এ জন্মে হয়তো
আমি তোমার কাছে পৌঁছুতে পারবনা;
তাহলে ,আগামী জন্ম গুলো আমি কার দিকে আসবো ?
সূর্যকে ঢেকে তার কালোকেশে, জননীর নিখাদ মমতায় ঘুম জাগিয়ে পৃথিবীর চোখে, মধুর গুঞ্জনে আঁচলে বেঁধে নক্ষত্র রাত নেমে আসতো সুচতুর- ক্রমশ উচু হওয়া বিনাশী দেয়াল ডিঙ্গিয়ে, মখমলের শয্যায় ছলকে দিতে কামনার জল নামাতো বৃষ্টি অঢেল। মিটমিট করে তাকিয়ে থাকা একচোখা তারাগুলো ছাড়া আর কেউ জানতো না তার কথা, না তির্যক বাতাস না হিংসুটে জ্যোৎস্নার দল।
আজ আর সেই রাত দেখি না, যা দেখি তার সবটুকুই আঁধার, জানি না কোথায় লুকিয়েছে সে, ভাসিয়েছে তার কোমল দেহ কার দ্যোতনায়, নাকি সেঁজেছে গ্রন্থকীট, আনকোরা উপমায় খুঁজে পেতে অমিয়তা! রোজকার আঁধার দেবী, এখন আর নেমে আসে না সমুদ্রকে বানিয়ে তার পা’য়ের নূপুর, স্রোতকে বানিয়ে অতুল ঝংকার, নেমে আসে না সেই তীর্থের রাত চোখটিপে ধুসর গোধূলিকে।