শনিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৪

ছোটগল্পের প্লট ও চরিত্র নির্মাণের কৌশল (সংগৃহীত)

ছোটগল্পের প্লট ও চরিত্র নির্মাণের কৌশল (সংগৃহীত) 
পন্ডিত মাহী ৫ অক্টোবর, ২০১২
==========================================

ছোটগল্পের প্লট ও চরিত্র নির্মাণের কৌশল
সফল প্লট নির্মাণের কৌশল:
একটি ভালো গল্পের মূল ভিত্তি প্লটের সফলতার উপর নির্ভর করে। বলা যায়, পাঠক একটি জমজমাট গল্প পড়ে যখন অভিভূত হন তখন এটিই প্রমাণীত হয় যে, লেখক খুব সফলভাবে কাজ করে সার্থক প্লট নির্মাণে দক্ষতা দেখিয়েছেন। সফল প্লট নির্মাণের কয়েকটি কৌশল আছে। যেমন:
 
ক) সাসপেন্স বা অনিশ্চয়তা
খ) পরিণতির পূর্বাভাস
গ) অতীতের কথা বা স্মৃতিচারণ
ঘ) গল্পের কাঠামো
ঙ) অবাক করা সমাপ্তি।


ক) সাসপেন্স বা অনিশ্চয়তা: ছোটগল্প শুরু করতে হবে আকস্মিক একটি কথা বা ঘটনার সূত্রপাত দিয়ে যা পড়ে প্রথমে পাঠক চমৎকৃত হবেন ও গল্পের ভেতরে অজানা-অনিশ্চিত কী আছে তা জানার জন্য আগ্রহী হবেন। তাঁর ভেতরে গল্পের সম্পূর্ণ কাহিনী জানার জন্য একধরনের তাগিদ তৈরি হবে।

খ) পরিণতির পূর্বাভাস: পাঠককে এমন অনিশ্চিত, জটিল বা রহস্য আচ্ছন্ন কাহিনীতে নিয়ে যাওয়া যাবে না, যা থেকে তিনি বিরক্ত হন। গল্প হতে হবে তার চেনাজানা মানুষজন ও পরিবেশ থেকে। এ কথার অর্থ এই নয় যে, কল্পনা ও রহস্যের জগৎ থেকে কিছু লেখা যাবে না। বস্তুত লেখক গল্পের কাহিনীতে অতিরিক্ত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই কথা ও বর্ণনা দেবেন না। গল্পের কাহিনীতে পাঠককে ধীরে ধীরে নিয়ে যেতে যেতে লেখক গল্পের একটি পরিণতির আভাস দেবেন। এটি ভালো গল্পের জন্য জরুরি এবং তা পাঠকের মনের আকাঙ্ক্ষাকে পরিপূর্ণ করে তোলে। লেখক গল্পের মাঝে মাঝে এমন কিছু ক্লু ছড়িয়ে দেবেন যা থেকে পাঠকের এই উপলব্ধি হয় যে, এটি তাঁর পরিচিত ভুবনের গল্প। তিনি অনুমান করতে পারেন যে, কাহিনীর পরবর্তী ধাপগুলো কী হতে যাচ্ছে।

গ) অতীতের কথা বা স্মৃতিচারণ: ছোটগল্পে এই কৌশলটি খুব সার্থকভাবে প্রয়োগ করা যায়। এখানে লেখক গল্পের সেই অংশটুকু বলতে পারেন যা কাহিনীর শুরুতে বলা হয়নি, কিন্তু কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুরোনো কথা বা ঘটনাগুলো বলা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল অনেক লেখক এই কৌশলটির সফল প্রয়োগ করেন যাতে পাঠকের মনে সেই পরিচিত মানুষজন আর ঘটনার বাস্তবতা দেখা যায়। এটি মূলত গল্পের প্লটের সেই পরিচিত অংশ যা পুরো কাহিনীর গতিময়তা দিয়ে থাকে।

ঘ) গল্পের কাঠামো: এটি হলো গল্পের ভেতরের গল্প অর্থাৎ লেখক যে গল্প বলতে শুরু করেছেন এবং সেজন্য নানান চরিত্র নির্মাণ করেছেন, সেই চরিত্রগুলোর নিজস্ব গল্প আছে আর সেসবের সুবিন্যস্ত উপস্থাপনা হলো গল্পের কাঠামো। ভালো প্লট একটি গল্পের কাঠামো ছাড়া তৈরি করা যায় না। এখানে লেখক গল্পের চরিত্র নির্মাণ ছাড়াও কল্পনাশক্তি, আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-ব্যর্থতা, পরিবেশ ও আমেজ নির্মাণ করে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে থাকেন।

ঙ) অবাক করা সমাপ্তি:
লেখক যে আকস্মিক ও আকর্ষণীয় বাক্য নিয়ে গল্পের সূত্রপাত করেছেন তার সমাপ্তিও টেনে দেবেন এক আকস্মিক সমাপ্তি দিয়ে, যা হয়তো পাঠকের কাছে বিস্মিত এক পরিণতির মতো লাগে। সতর্ক পাঠক এমন একটি সমাপ্তির প্রত্যাশা করেন।

চরিত্র (Character):

ছোটগল্পে যে কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে তা অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রগুলো অপেক্ষা অনেক পরিস্ফুট ও স্বচ্ছ। মূলত গল্পের কাহিনী ও বর্ণনা তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এখানে লেখক সেই চরিত্রের পেছনের কথা ও বর্তমানের কথা বলেন। তার ভাবনা, উপলব্ধি, স্বপ্ন-সাধ, আশা-হতাশা, অভ্যাস, মনমানসিকতা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলো গল্পের নিরিখে যেমন প্রযোজ্য তেমনভাবে লিখে থাকেন। একটি-দুটি কথাতে বা ঘটনাতে লেখক এই চরিত্রটির সার্বিক প্রতিচ্ছবি আঁকতে পারেন। অন্যান্য পার্শ্ব ও লঘু চরিত্রগুলোর কথা বাদ দেয়া যায় না, তবে তা কেন্দ্রীয় চরিত্রের মতো বিশদ নাও হতে পারে। লেখক যে চরিত্র সৃজন করেন ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তাকে চরিত্রায়ন বলা যায়। লেখক সাধারণত দুটি মৌলিক কৌশল অনুসরনের দ্বারা চরিত্রায়ন বা চরিত্র সৃজন করে থাকেন।
 
১) সরাসরি চরিত্রের কথা বলা

 ২) ঘটনা বা চরিত্রের ভাবনা, উপলব্ধি, স্বপ্ন-সাধ, আশা-হতাশা, অভ্যাস, মনমানসিকতা ইত্যাদির মাধ্যমে পাঠকের কাছে চরিত্রটির মূর্ত রূপ তুলে ধরা।

গল্পের চরিত্র কাহিনীর প্রয়োজনে নানারকমের হতে পারে। লেখক নিজেই সৃষ্টি করেন তার কাহিনীর নায়ক-নায়িকা-ভিলেন-সহযোগিগণ কেমন মানুষ হবে। তারা কি পরিচিত ভূবনের নাকি কল্পনার জগতের? মূলত সফল গল্পের প্রয়োজনে পরিচিত ও বাস্তব বা বাস্তবের মতো চরিত্র সৃজন করা জরুরি। এই চরিত্রগুলোর মধ্যে নানান ঘটনা, সংঘাত, মিল-অমিল গল্পের কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যায় ও একটি পরিণতি দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে লেখকের অভিজ্ঞতা ও কল্পনাশক্তি অনেক কাজ করে থাকে। লেখক তার কাহিনীর প্লট অনুসারে চরিত্রের প্রতিচ্ছবিকে নানাভাবে মূর্ত করে তোলেন। যেমন:

১) প্রধান বা কেন্দ্রীয় চরিত্র: এই চরিত্রটি সমগ্র গল্পে একটি বিশেষ ও স্বতন্ত্র ভূমিকা নিয়ে এগোবে। তার কথাবার্তা ঘটনা সংঘটন ইত্যাদিতে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট প্রকাশ পাবে। এই চরিত্রটি গল্পের কাহিনীর উদ্দেশ্য ও পরিণতিতে বড় ও মূল ভূমিকা রাখে।
২) পারিপার্শ্বক চরিত্র: এই চরিত্র বা চরিত্রগুলো গল্পের কাহিনীর বিস্তৃতির জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু তার বা তাদের অবস্থান ও ঘটনা প্রবাহ গল্পে অনেকটা অতিথির মতো। তাদের ভূমিকা গোলাপ প্রস্ফুটিত হওয়ার পেছনে গাছকে মাটির রসে সঞ্জীবিত করার মতো নেপথ্য শক্তি। পাঠক তাদের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ‘কম’ পরিচিত হন, তাদের সীমিতভাবে দেখেন ও শোনেন কিন্তু কাহিনীর এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের ভূমিকা অনেক বেশি ও জরুরি।

৩) সরল ও অপরিবর্তনীয় চরিত্র: গল্পে এ চরিত্রগুলোর অবস্থান এক মতো অর্থাৎ পাঠকের মনে তাদের একই ধাঁচ ও ছবি ফুটে উঠে।
৪) পরিবর্তনশীল চরিত্র: এই চরিত্রগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে একক ব্যক্তিত্ব বা চরিত্র রূপলাভ করে থাকে।
৫) নিশ্চল বা স্থির চরিত্র: এ চরিত্রটির বৈশিষ্ট হলো এগুলো গল্পের মধ্যে পরিবর্তিত হয় না। নিশ্চল একটি ভূমিকা নিয়ে থাকে।
৬) গতিময় চরিত্র: এ চরিত্রটি গল্পের কাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন ঘটনার সূত্রপাত করে গল্পকে গতিশীল করে থাকে।
৭) স্টিরিওটাইপড্ বা ছাঁচে ঢালা চরিত্র: এ চরিত্রগুলো আমাদের অতি জানাশোনা ও পরিচিত ব্যক্তি যাদের আগমন, আচরণ খুব চেনা ও আগাম বলে দেয়া যায় যে, তারা কী করবে।

লেখক তার গল্পের কাহিনীর প্রয়োজন অনুসারে চরিত্রগুলোর সমাবেশ করেন। তাদের দ্বারা নানান কথা বলান, ঘটনা ঘটান এবং গল্পকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যান। এই চরিত্রগুলো কখনো সরাসরি বা প্রত্যক্ষ আবার কখনো প্রচ্ছন্ন বা পরোক্ষভাবে উপস্থাপিত হয়। যেমন: আমরা যদি অধ্যাপকের একটি চরিত্র উপস্থাপন করতে চাই, তখন সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে বলতে পারি, তিনি একজন অধ্যাপক, কলেজে শিক্ষকতা করেন। আবার পরোক্ষভাবে যদি দেখানো যায় যে, তিনি কলেজের ক্লাসে পড়াচ্ছেন তাহলে সহজে বোঝা যায় যে চরিত্রটি কলেজের শিক্ষক বা অধ্যাপক।

0 মন্তব্য:

Facebook Comments by প্রহেলিকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by প্রহেলিকা