সোমবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৪

ঘুমের ঘোরে পথ চলা



আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে বুঝতেছিনা। সেই যে ট্রেন আসি আসি করে ৬ টা ঘন্টা পার করে দিলাম তারপরও ট্রেন আসছে না। কিন্তু আমাকে যে কাল সূর্য ওঠার আগে আদিত্য বৃক্ষটির কাছে পৌছাতে হবে। পৃথিবীতে সে ই একটি মাত্র বৃক্ষ, আর সে তার জীবনের একটিবারই ফল দেয়। সেই ফলটি ফলবে কাল সকাল ভোরে এবং সূর্য উঠার সাথে সাথে আবার বিলীন হয়ে যাবে, আর সেই ফল ভক্ষণের মাঝেই রয়েছে আমার বেচে থাকার আসা, আমার রোগমুক্তি।


কিন্তু ট্রেন এর তো কোনো দেখা পেলাম না এখন পর্যন্ত। তাহলে কি আমার আর যাওয়া হবে না ? তাহলে কি আমাকে আমার এই জীর্ণতা নিয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে ? দেখতে দেখতে  আমার মত সকল মানুষ জড়ো হয়েছে সেই বৃক্ষের ফল ভক্ষণের আসায়। সবার শুধু একটায় লক্ষ্য আজ সেই বৃক্ষের কাছে পৌছানো।

দুপুর প্রেইয়ে বিকাল আর বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সবার দৃষ্টি যেন ট্রেনের ল্যাম্প পোষ্টের দিকে কখন তা জ্বলে উঠবে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই কাঙ্খিত লালবাতি জ্বলে উঠলো। জ্বলে উঠার সাথে সাথেই সবাই হৈ  হৈ করে উঠলো। ট্রেনের সাইরেন শুনা যাচ্ছে। ট্রেন গোচরে আসার সাথে সাথেই বাধলো যত বিপত্তি , এতক্ষণ ধরে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা আমার মত শত শত যাত্রিগুলো হঠাৎ যেন উন্মাদ হয়ে গেল। তাদের আর কারদিকেই খেয়াল নেই শুদু তাদের মস্তিস্কে একটাই ভাবনা ট্রেন ধরার আর সেটা যেকোনো কিছুর বিনিময়েই হোক।

যেই না যাত্রীবোঝাই টট্রেনটা এসে  প্লাটফর্মে থামলো সাথে সাথে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল ট্রেনের প্রবেশদ্বারে। যে যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে তাদের জায়গা কিন্ত আমি ? তাদের এই ভীড়ে আমি যেন কোন ঠাই  পাচ্ছি না। সবাই শুধু আমাকে ঠেলে সামনে চলে যায়, যদিও প্রথম থেকে আমার অবস্থান ছিল সবার প্রথমে , আর সেই আমি আজ সবাই শেষে। বলার উপেক্ষা রাখেনা সব যাত্রীর মাঝে শুধু  আমিই ছিলাম পাতলা এবং সম্পূর্ণ রোগা। আর তার কারণেই আমারই শুদু ঠাই  হলো না ট্রেনে।

ট্রেন চলে যাচ্ছে আর আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।বাকি সবাই ঠেলাঠেলি করে ট্রেন ধরতে পারলেও রয়েগেলাম আমি। এখন আর আমার পাসে কেউ নেই রাত তখন ১১টা। হাটছি তো হাটছি সেই রেললাইনের পথ ধরে ঘুটঘুটে এই শর্বরীতে যেখানে সুধাকরের প্রভাও অনুপস্থিত। হঠাৎ কারো ডাক শুনে পিছনে ফিরে তাকাই।  দেখলাম একটি মেয়ে আমাকে ডাকছে হাতের ইশারায়। আমি প্রথমে একটু অবাক হলাম এই বিদঘুটে রাতে একটি  দেখে। ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঘেশ করলাম সে কে ? সে জবাব দিল '" যেই পথে তুমি হেটে যাচ্ছ সেটা আমারি পথ" অপরূপ সুন্দর সে তাই শুধু চেয়ে থাকলাম অপলক ভাবে। আমার নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে আমার কাছে সে জানতে চাইল আমি কেন এত রাতে এই পথ ধরে হাটছি। যেহেত তারই অধীনস্ত পথ ধরে হাটছিলাম তখন তাকে বললাম আমার সেই ট্রেনে স্থান না হওয়ার কথা। শুনে সে শুধু হাসলো আর বলল সবাই ধরল ট্রেন শুধু তুমি পারলে না ? তখন আমি বললাম আমিতো আর তাদের মত না। আমিতো  আর তাদের মত করে শক্তিশালী হয়ে জন্ম নেয়নি তাই আমি পারিনী।

সে একটু চুপ করে থেকে বলল আচ্ছা যাও তুমি যেই পথে যাচ্ছিলে দেখো চেস্টা করে কোনো উত্স খোজে পাওকিনা। তার চঞ্চলাময়ী হাসিতে তার প্রতি একধরনের দুর্বলতা জন্ম নিল আমার। আমাকে যাওয়ার কথা বললে আমি তাকে বললাম আমি বাচতে চাই এই সুন্দর পৃথিবীতে। আমাকে কোনো উপায় বলে দাও কিভাবে আমি সেখানে পৌছাতে পারি। কিন্ত সে চলে যেতে চাইল। আমি আমার আকুল মিনতি দিয়ে তার পথরোধ করলাম। একসময় সে বাধ্য হয়েই বলল চল তাহলে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। সে বলল সামনে একটা নদী আছে চল সেখানে গিয়ে দেখি কোনো নৌকা পাওয়া যায় কিনা। নদীপথে গেলেও তুমি তুমার লক্ষে পৌছাতে পারবে। তার কথামত দুজনেই হেটে চললাম সেই নদীর তীরের দিকে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে দুজনকে অবাক করে দিয়ে সেই নদী দিয়েই বয়ে যাচ্ছিল একটি ইঞ্জিন বাহিত নৌকা। খুব জোরে শব্দ আসছিল ইঞ্জিনের যেটা আমাদের কানেও পৌছালো। আমার পাসে দাড়িয়ে থাকা সেই অপরূপ মেয়েটি আমাকে বলল জোরে ডাক সেই মাঝিকে সেই হবে করতে পারবে তোমাকে পার। আমিও ডাকা শুরু করলাম মরিয়া হয়ে হয়ে যেন এই আমার শেষ আসা। ইঞ্জিনের জোরালো শব্দে আমার ডাক যেন মাঝির কানেই যাচ্ছে না , মরিয়া হয়ে দিকেই চলেছি কিন্তু মাঝির কোনো গাত্রদাহ হলো না।  একসময় মেয়েটি আমাকে বলল স্পষ্ট করে ডাক তুমি মাঝিকে। তোমার শব্দগুলোতো স্পষ্ট না। একে ইঞ্জিনের শব্দ এর উপর তুমি যদি অস্পষ্ট করে ডাক তাহলে তো মাঝি শুনবে না। আমিও আপ্রাণ চেস্টা করে দিকেই চলছি আর, মাঝিও বেয়ে চলছে তার তরী আপন গতিপথে। এভবে দেখতে দেখতে বিলীন হয়ে গেল শেষ আশার তরীটি।  অপুরুপা আমার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমাকে বলল তুমি যেভাবে ডাকলে মাঝিত দুরে থাক আমিই তো তোমার কথা স্পষ্টভাবে শুনতে পায়নি। অন্যকোনো পুরুষ মানুষ হলে এই নৌকাটি আর এভাবে চলে যেতে পারত না। তখন আমি তাকে বললাম দেখো আমি তাদের মত নই। আমি তাদের মত স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারি না। জন্ম থেকেই আমার টাই-টাং এর সমস্যা যার কারণে আমি স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে পারি না।

দুজনেই সেই নদীর পথ ধরে হাটতে থাকলাম। হাটতে হাটতে একসময় বোঝতে পারলাম না আমার হয়ত সেই আদিত্য বৃক্ষের কাছে পৌছানো সম্ভব না। সেখানে পৌছানোর জন্য যা দরকার তার কোনো কিছুই আমার কাছে নেই। আমার কাছেতো কিছুই নেই, আমি কোন যোগ্যতায় সেখানে পৌছার আশা করি? নিজেকে আবিষ্কার করলাম একজন অযোগ্য পুরুষ হিসেবে। সাথের সেই অপরুপা সঙ্গীটিকে বললাম আমি আর সেখানে পৌছাতে চাই না। আমি আমার জীবনের স্বাদ পেয়েগেছি তোমার সাথে এই পথচলে। আমার জীবনে যদি কিছু সুখের মুহূর্ত থেকে থাকে সেটা হলো আজকে তোমার সাথে এই পথচলা। তোমার পাশে পথচলার এত সুখ সেটা হয়ত আমি বঝ্তাম না যদি জীবন বাচানোর রাস্তায় প্রথম ট্রেনটা আমি মিস না করতাম। তুমি ফিরে যেন তোমার আপন ঘরে হে অপরুপা , আমি আমার বাকি জীবনটা কোনো ভাবে কাটিয়ে দিব। অসুস্থ এই শরীরের রোগগুলো থেকে সারা পেতে তো আদিত্যে বৃক্ষের কাছে যাওয়াই হলো না। আর বেছে থাকার কোনো আশাই অবশিষ্ট রইলোনা আমার জীবনে।

অপরুপা অনেকক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল 'আমরা দুজন পথ চলতে চলতে অনেক দূর হেটে চলে আসছি যা আমরা নিজেরাও জানি না। অনেকটা পথ পিছনে ফেলে আসছি এখান থেকে আর ফিরে যাওয়ার সম্ভব না।  আমাকে সে বলল আমি তোমার পাসে আছি এবং সারাজীবন থাকব যতদিন বেছে থাকি এই নশ্বর পৃথিবীতে। আমি যখন তুমার হাত ধরে এতুটুকু পথ হেটে আসছি আমি আমার জীবনের বাকি পথটুকু তোমার সাথেই হেটে যেতে চাই। সেই অপরুপা মেয়েটি আমাকে উত্সাহ দিতে থাকলো আর জানালো আমরা হাটতে হাটতে সেই আদিত্য বৃক্ষের অনেক কাছে চলে আসছি। মনে আবার বাচার আশা জেগে উঠলো আমার। চিত্কার করে অপরুপাকে বললাম আমি তোমাকে ভালবাসি অনেক ভালবাসি। হে অপরুপা তুমি যখন আমার পাসে থাকবে বলেছ তখন আমি হেরে যেতে পারিনা আমি পৌছাবই সেই বৃক্ষের কাছে। তুমি শুধু আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যেও।

নুতুন করে বাচার স্বপ্ন নিয়ে তার সাথে হাতে হাত রেখে হেটে চললাম। জীবনের রংটাই যেন বদলে গেল তাকে পাশে পেয়ে হায়রে ভালবাসা অনেক মধুর একটা জিনিস। ভালবাসাই পারে চলার পথে সকল বাধা দূর করে নুতুন জীবনে বেছে থাকার স্বপ্ন দেখাতে। যেকোনো কঠিন কিছু কোমল  করা যায় শুধু ভালবাসা দিয়ে। এসব ভাবতে ভাবতে তার হাত ধরে চলতে চলতে দেখলাম সেই আদিত্য বৃক্ষটি আসতে আসতে স্পষ্ট হতে লাগলো চোখের দৃষ্টিতে। তার মানে আমি কি শেষ পর্যন্ত পৌছাতে পারলাম ? নিজেকে জয়ী মনে হলো অনেক কিন্ত এই জয়ের পিছনে যার এত অবদান সেই উপরুপাকে খুশিতে আমার এই বকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। সেও আমাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আর বলল তোমার বুকে এত শান্তি আমি যে আর কোনদিন এমন প্রশান্তি পাইনি। হঠাৎ দেখলাম আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেই অপরুপা ঘুমিয়ে পরেছে।   সারাটা রাত আমার সাথে পথ চলতে চলতে ক্লান্ত অপরুপা আমাকে জড়িয়ে ধরে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে আমার বুকেই ঘুমিয়ে পরেছে। তাই তার এই ঘুমটাকে ভাঙানোর শক্তি আমার ছিল না।

লাল সূর্য পূর্ব দিকে উদয় হল। এখনো সেই অপরুপা আমার বুকে ঘুম। আমি তাকিয়ে থাকলাম সেই আদিত্য বৃক্ষটির দিকে , সূর্য উঠার সাথে সাথেই সব ফল বিলীন হয়ে গেল। আমার কোন আফসোস হলনা ফলের জন্য শুধু এটাই মনে হল এই অপরুপাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ফল আমার জীবনের বড়  সম্পদ। তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে ফল খাওয়ার সাহস আমার নেই। আমি ঘুম ভাঙ্গিয়ে ফল নেওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও সূর্যের আলো তা মানলো না। সে ঠিকই আমার অপরুপার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। 

কে আপনি আর আমি বা এখানে কেন ? অপরুপার ঘুম ভাঙ্গার পর এটাই ছিল তার প্রথম প্রশ্ন। আমি বিন্দু মাত্র অবাক হয়নি। তাকে সব বললাম রাতের ঘটনা। সব সনে সে আমাকে বলল "আমি ঘুমের ঘোরে ছিলাম, এটা আমার একটা অসুখ যে আমি মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরেই  পথ চলি। আমি শুধু তাকিয়ে থাকলাম অপলক ভাবে তার দিকে। সে ক্ষমা চেয়ে আমার কাছে বলল " আমাকে মাফ করে দিবেন আজ আমার জন্য আপনি আসতে আসতে মৃত্যুর দিন গনবেন কিন্তু এখন আমাকে যেতে হবে আমার ঠিকানায়। আমার ঘরে কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তা বলে আমাকে সে অনুরোধ করলো তাকে সেই জায়গায় পৌছে দেয়ার যেখান সে আমাকে পিছন থেকে ডেকেছিল। 

আমি এখন ছেলের মত জয়ী রাজার হাসি হাসতে হাসতে তাকে পৌছে দিতে যাচ্ছি। 

0 মন্তব্য:

Facebook Comments by প্রহেলিকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by প্রহেলিকা