মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০১৪

তার শয্যার পাশে

শুয়ে আছে একজন নিরিবিলি ভোরের শয্যায়
শীত-গোধূলির শীর্ণ শব্দহীন নদীর মতন
শিথিল শরীর তার লেগে আছে ফ্যাকাশে চাদরে,
দেয়ালে আলোর পরী। খোলা দরজা। ঘরে ঠাণ্ডা হাওয়া
খেলা করে, ঝরনা-হাওয়া ঝরে,
ঝরে একমাথা চুলে, ঝরে
করুণ ক্লান্তির ভারে বুজে-থাকা চোখের ওপর।
পাখা নেড়ে, শিস দিয়ে হলদে পাখি উড়ে গেল মেঘে
নির্জন বারান্দা থেকে। সারা ঘরে শান্তি স্তব্ধতার,
কখনো হঠাৎ তার নিমীলিত শুকনো গলা শুনি
ছায়া-ছায়া-আলো-স্বর-হয়তো ডেকেছে জল দিতে।

শিরশিরে হাওয়ায় কাঁপে শরীরের মেরুন র‍্যাপার।

চৈতন্যের আলো পড়ে ঘুম-পাওয়া সত্তার পাপড়িতে,
সূর্যের চুমোয় লাল পাণ্ডু গাল। টেবিলের দুটি
তরুণ কমলালেবু চেয়ে আছে দূরের আকাশে,
চিকন সোনালি রুলি ম্রিয়মাণ শঙ্খশাদা হাতে
যেন বেদনায় স্থির-মনে হল-সেই দুটি হাত
মায়াবী নদীর ভেজা সোনালি বালিতে আছে প’ড়ে!
ফ্লাস্কে দুধ। শিশি। ওডি-কলোনের ঘ্রাণ উন্মীলিত
সারা ঘরে। পেশোয়ারি বেদানার ফিকে-লাল রস
কাচের গেলাশে ভরা- গোধূলি-মদির।
কাল সারারাত ছায়া-অন্ধকারে প্রতি পলে পলে
মোমের শিখার মতো ইচ্ছা তার জ্বলেছিল এই
ভোরকে পাওয়ার। চোখে ছিল
গাঢ় প্রার্থনার ভাষা, বুকে
উজ্জ্বল আকাঙ্ক্ষা প্রীত জীবনের, সৌন্দর্যের সাধ।
কে যেন তারার মতো কাল রাতে ডেকেছিল তাকে
মূক ইশারায় দূরে তবু সেই একজন জানি
ভোরকেই চেয়েছিল উন্মথিত রক্তের ভিতর
যেমন সে পেতে চায় প্রেমিকের চুমোর আদর
রাত্রির জঠরলগ্না। ছায়াচ্ছন অপদেবতার
অমর্ত্য চোখের নিচে রাত তার কাটে হরিণের
করোটির ছবি নিয়ে, সারাক্ষণ জেগে থেকে কাল
শুনেছে ধূসর ধ্বনি অবচেতনার অন্ধকারে।

এখন সে শুয়ে আছে ক্লান্তপ্রাণ সম্রাজ্ঞীর মতো
ভোরের আলোয় নেয়ে, ডুবে আছে মসৃণ আরামে।
জেগে উঠে হাত নেড়ে, সোনালি রুলির শব্দ করে
গোধূলি-মদির শান্ত বেদানার রস নিল চেয়ে,
হাসির আশ্চর্য জ্যোৎস্না তার
ঠোঁট চুয়ে ঝরে গেল (হায়,
অপদেবতার ক্রোধ) ঝরে গেল ভোরের শয্যায়।
অতল হৃদয় বেয়ে উঠল গান, শান্ত শব্দহীন,
চোখে তার উপচে-পড়া অপরূপ জয়ের উল্লাস।
ভোরকেই চেয়েছিল উন্মথিত রক্তের ভিতর।

সেই একজন।

কাব্যগ্রন্থ: দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০)

0 মন্তব্য:

Facebook Comments by প্রহেলিকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by প্রহেলিকা